মানবপাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব

পুলক ঘটক
2019.05.17
ঢাকা
মানবপাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব মানবপাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব। ঢাকা ১৭ মে।
ছবি: বেনার নিউজ

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে দুইটি মানবপাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

ইউরোপে মানবপাচারকারী অন্তত ১৫টি চক্রের ‘অস্তিত্ব’ বাংলাদেশে আছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, “তদন্তে ইউরোপে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত দেশজুড়ে অন্তত ১০-১৫টি চক্রের তথ্য পেয়েছে র‌্যাব-১ ব্যাটালিয়ন। এর মধ্যে পাঁচ-ছয়টি চক্রের মাধ্যমে পাচার হওয়া বাংলাদেশিরা সেদিন (১০ মে) নৌ-দুর্ঘটনায় পতিত হন।”

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে শুক্রবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। গত ৯ মে লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে অন্তত ৩৯ জন বাংলাদেশি নিখোঁজ এবং ১৪ জন জীবিত উদ্ধার হন ।

র‌্যাব ওই ঘটনার পরই তদন্তে নামে জানিয়ে কমান্ডার মুফতি বলেন, “ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিমের স্বজনরা শরীয়তপুরের নড়িয়া ও সিলেটের বিশ্বনাথ থানায় দুটি মামলা করেছেন। ওই মামলার ছায়া তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দুইটি চক্রের তিনজনকে আটক করা হয়েছে।”

আটক হওয়া শরিয়তপুরের আক্কাস মাতুব্বর (৩৯), সিলেটের এনামুল হক তালুকদার (৪৬) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া (৩৪)ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহতদের পাচারে জড়িত ছিলেন।

“সিলেটের জিন্দাবাজারে ইয়াহিয়া ওভারসিজ নামে একটি এজেন্সি আছে এনামুলের। তিনি ১০/১২ বছর ধরে মানবপাচারে জড়িত। আব্দুর রাজ্জাক এবং আক্কাস এনামুলের দালাল হিসেবে কাজ করছিলেন,”বলেন মুফতি।

আটক তিনজনের চক্রের মাধ্যমে মোট কতজন সেখানে গিয়েছিলেন বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয় র‌্যাব। তবে তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মনে করছে তারা।

“তবে দেশজুড়ে যে ১০-১৫ টি চক্রের খবর আমরা পেয়েছি, তাদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে,” যোগ করেন মুফতি।

ইউরোপের তিন রুট এবং ‘গুডলাক ভাই'

র‌্যাবের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে পাচারে তিনটি রুট ব্যবহৃত হয়। রুটগুলো, বাংলাদেশ-ইস্তাম্বুল (তুরস্ক)-লিবিয়া, বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা-ইস্তাম্বুল(ট্রানজিট)-লিবিয়া এবং বাংলাদেশ-দুবাই -আম্মান (জর্ডান) (ট্রানজিট) - বেনগাজী (লিবিয়া) - ত্রিপোলি (লিবিয়া)।

পাচারকারীরা সড়ক ও বিমানপথ ব্যবহার করে লিবিয়া পৌঁছায়। সেখান থেকে নৌপথে তিউনিসিয়ার উপকূল হয়ে ইউরোপে পাচার করে থাকে।

লিবিয়ার ত্রিপোলিতে কথিত ‘গুডলাক ভাই’নামে এক বাংলাদেশি তাদের দায়িত্ব নেয়। সেখানে তাদের কয়েক দিন থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ওই সময় দেশে পরিবারের কাছ থেকে চুক্তির বাকি টাকা আদায় করা হয়।

এরপর ত্রিপোলির বন্দর এলাকায় অন্য একটি সিন্ডিকেটের কাছে তাদের হস্তান্তর করা হয় ইউরোপে পাচারের জন্য। সেখানেও টাকা লেনদেন হয়।

মুফতি বলেন, “ওই সিন্ডিকেট সমুদ্রপথে নৌযান চালনা, সমুদ্রে দিক নির্ণয় যন্ত্র ব্যবহারসহ কিছু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে নৌকায় তুলে দেয় পাচারের শিকার মানুষগুলোকে। তিউনিসিয়া চ্যানেল হয়ে ইউরোপের দিকে রওনা করে তারা। এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।”

প্রলোভনই আকর্ষণ

র‌্যাব জানায়, এই চক্রের দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়।

“তারা প্রথমে বিদেশে গমনেচ্ছুক নির্বাচন করে, এরপর ধাপে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া এবং সর্বশেষ ধাপে লিবিয়া থেকে তাদের নৌপথে ইউরোপে পাঠায়,” বেনারকে বলেন র‌্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান।

এই সিনিয়র এএসপির দাবি, “অর্থের বিনিময়ে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় নৌপথের ঝুঁকির বিষয়গুলো জানানো হয় না।  নৌপথে নেওয়ার আগে শুরু হয় কালক্ষেপণ। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লাগে দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত।”

মুফতি মাহমুদ খানের দাবি, “ভিকটিমদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয় এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়।”

“ইউরোপে পৌঁছে দিতে তারা সাত-আট লাখ টাকা অর্থ নির্ধারণ করে, এর মধ্যে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা লিবিয়ায় পৌঁছানোর আগে এবং বাকি টাকা লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাত্রার আগে পরিশোধ করতে হয়,” বলেন তিনি।

চক্র ভাঙার তাগিদ

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক ড. সি আর আবরার বেনারকে বলেছেন, “বাংলাদেশের যেসব চক্র এই ব্যবসায় জড়িত, তারা মানবপাচারকারী আন্তর্জাতিক চক্রের স্থানীয় এজেন্ট। মানবপাচার বন্ধ করতে হলে স্থানীয়দের ধরার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চক্রগুলোকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা দরকার।”

“আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ভাঙতে হলে বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পারস্পরিক সহায়তার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে,”বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন বিষয়ক কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, “লিবিয়া যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ হওয়ায় সেখানে নানা দেশের অপরাধী চক্র কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। সেই চক্র ভাঙা বাংলাদেশের জন্য সহজ নয়। বরং বাংলাদেশ স্থানীয় চক্রগুলো ভাঙতে পারে।

তাঁর মতে, বাংলাদেশ স্থানীয়ভাবে সফল হলে গর্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বলতে পারবে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির সহযোগে সেখানেও ভূমিকা রাখতে পারবে।

“বাংলাদেশে শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার হচ্ছে। এখানকার মানুষের মনস্তত্ত্ব এমন যে তারা মনে করে ইউরোপে গেলেই ভাগ্য বদলে যাবে। কিন্তু ইউরোপে গেলেই যে ভাগ্য বদলাবে না, বরং অবৈধভাবে গেলে তাদের ফেরত পাঠানো হবে –এই বিষয়টি ব্যাপকভাবে জনসাধারণকে জানাতে হবে,” বলেন শরিফুল।

সংকুচিত শ্রমবাজার

রামরু’র গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদারের দাবি, কর্মক্ষম বাংলাদেশিরা একাধিক কারণে অবৈধপথে ইউরোপমুখী হচ্ছেন।

বেনারকে তিনি বলেন,  “দেশের চাকরির বাজারে প্রতি বছর ২৬ হাজার নতুন চাকরি প্রত্যাশী আসছে। কিন্তু সেভাবে কর্মসংস্থানের তৈরি হচ্ছে না।  তা ছাড়া ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর আমাদের ১২-১৪ লাখ  লোক বৈধ পথে বিদেশে গিয়েছে। কিন্তু গত কয়েকবছর আমরা সাত থেকে সাড়ে সাত লাখের বেশি পাঠাতে পারিনি।”

“বিদেশে আমাদের বৈধ শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে গেছে, নতুন বাজারও তৈরি হচ্ছে না, এদিকে বেকারত্ব বাড়ছে – সব মিলিয়ে মানুষ যেকোনোভাবে বিদেশ যাওয়ার জন্য ‘মরিয়া’ হচ্ছে। ”

মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় আসার পর মালয়শিয়া আর বাংলাদেশি নিচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আররে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ হয়েছে। দুবাইও ২০১২ সালের পর লোক নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে, বলেন এই অভিবাসন বিশ্লেষক। #

ঢাকা থেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন শরীফ খিয়াম।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।