সৌদিতে কর্মরত নারীদের দায়দায়িত্ব দুই দেশের রিক্রুটিং এজেন্সির

জেসমিন পাপড়ি
2019.12.02
ঢাকা
191202_Female_worker-Saudi_Arab_1000.jpeg চোখেমুখে নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরা একজন নারী কর্মী। ছবিটি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তোলা। ২২ আগস্ট ২০১৯।
[সৌজন্যে: ব্র্যাক]

সৌদি আরবে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশি নারী কর্মীদের দেখভালের দায়িত্ব এখন থেকে দুই দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিকে বহন করতে হবে। যেসব নারী কর্মী দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন, না ফেরা পর্যন্ত তাঁদের আবাসনসহ অন্যান্য দায়িত্বও বহন করবে রিক্রুটিং এজেন্সি।

নির্যাতিত হওয়ার অভিযোগে সৌদি আরব থেকে একের পর এক নারী কর্মী দেশে ফিরে আসার প্রেক্ষিতে দুদেশের যৌথ কারিগরি কমিটির সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব জাহিদ হোসেন।

সৌদি আরব থেকে দেশ ফিরে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাহিদ হোসেন জানান, “নারী কর্মী যতদিন কর্মরত থাকবেন, ততদিন তাঁর দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের রিক্রুটিং এজেন্সি (নিয়োগকারী সংস্থা) বহন করবে।”

এছাড়াও নারী কর্মীদের সুরক্ষায় নজরদারি বাড়াতে অনলাইন প্লাটফর্মে কর্মী নিয়োগে সংশ্লিষ্ট সকলের তথ্য সংগ্রহ করাসহ সরকারিভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়।

প্রবাসী কল্যাণ সচিব সেলিম রেজা বলেন, “কোনো বিপদগ্রস্ত নারী কর্মীর সুরক্ষার বিষয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠলে সৌদি আরবের সুরক্ষা ও সহায়তা বিভাগ দ্রুত ব্যবস্থা নেবে। সংশ্লিষ্ট শ্রম কল্যাণ উইং বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আনবে।”

এছাড়া “বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুমতি ছাড়া কর্মীর নিয়োগকর্তা (কফিল) পরিবর্তন করা যাবে না,” জানিয়ে সচিব সেলিম রেজা বলেন, বাংলাদেশের নারী কর্মী নির্যাতন বা মৃত্যুর ঘটনা সৌদি সরকার আলাদা করে তদন্ত করবে।

“এবার সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষকে অনেক আন্তরিক মনে হয়েছে। নারী কর্মীদের সুরক্ষায় তাঁরা ইতিমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। আরো নেবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। নারী কর্মীদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেও দেওয়া হচ্ছে,” বলেন তিনি।

‘ইতিবাচক সিদ্ধান্ত’

নারী কর্মীদের সুরক্ষায় দুই দেশের নেওয়া এসব সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা। যত দ্রুত সম্ভব এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সৌদিতে নারী কর্মীরা ‍সুরক্ষিত হবে বলে মনে করেন তাঁরা।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বেনারকে বলেন, "নারী কর্মীদের সুরক্ষার যেসব বিষয়ে সৌদি আরব ও বাংলাদেশ এখন একমত হলো সেসব বিষয় দেশটিতে যাওয়ার আগে চূড়ান্ত হওয়ার দরকার ছিল। এতে বোঝা যায় কতটা অনিরাপদভাবে আমরা সৌদি আরবে আমাদের নারী কর্মীদের পাঠাচ্ছি।”

“নারী কর্মী পাঠানোর চার বছর পরে হলেও তাঁদের সুরক্ষার বিষয়ে যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, বিষয়টি ইতিবাচক,” বলেন তিনি।

তবে শুধু আশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে এসব সিদ্ধান্তের দ্রুত প্রয়োগ হলে নারী কর্মী নির্যাতন কমে আসবে বলে মনে করেন এই অভিবাসন বিশেষজ্ঞ।

বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বেনারকে বলেন, “এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে নিয়মিত নারী কর্মীদের খোঁজ খবর নিতে হবে। তাহলেই তাঁদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে।”

উল্লেখ্য, দুই দেশের মধ্যে করা চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে সৌদি আরবে নারী গৃহশ্রমিক পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ। কিছুদিন না যেতেই দেশটি থেকে ফিরতে শুরু করেন নারী কর্মীরা।

সরকারি হিসেবে, এ পর্যন্ত ২ লাখ ৯৩ হাজার ৫৮৮ জন বাংলাদেশি নারী কর্মী সৌদি আরবে আছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন কারণে দেশে ফেরত এসেছেন ৮ হাজার ৫০৭ জন।

ব্র্যাক অভিবাসন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে সাড়ে ১২ শ নারী কর্মী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এছাড়া দেশটি থেকে লাশ হয়েও ফিরেছেন ৫৩ জন নারী কর্মী।

ফেরত আসা নারীদের মুখে নির্যাতনের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন নারী সংগঠনের পাশপাশি সম্প্রতি জাতীয় সংসদেও সৌদি আরবে আর কোনো নারী গৃহকর্মী না পাঠানোর দাবি তোলেন কয়েকজন সংসদ সদস্য। এরই মধ্যে গত ২৭ নভেম্বর রিয়াদে দুদেশের মধ্যে যৌথ কারিগরি কমিটির তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

প্রবাসী কল্যাণ সচিব সেলিম রেজা বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সৌদি আরবের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট মিনিস্টার জাবের আব্দুল রহমান আল মাহমুদ নিজ নিজ দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে নারী কর্মীদের সুরক্ষার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়।

মুসানেদ প্লাটফর্ম

সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব জাহিদ হোসেন বলেন, “এখন থেকে সৌদি আরবে কোনো নারী গৃহকর্মী পাঠানোর আগে গৃহকর্তার পারিবারিক বিষয়সহ প্রয়োজনীয় তথ্য বাংলাদেশ খতিয়ে দেখবে।”

“এজন্য নারী কর্মীর বিস্তারিত ঠিকানা, দুই দেশের এজেন্সি ও নিয়োগকর্তার যোগাযোগের পূর্ণ ঠিকানা, নিয়োগকর্তা পরিবর্তনের তথ্য, আগমন, হস্তান্তর ও প্রত্যাবর্তনের তথ্য সৌদি সরকারের আইটি প্ল্যাটফর্মে (মুসানেদ) থাকতে হবে,” বলেন তিনি।

এছাড়া মুসানেদ সিস্টেমে বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি ‘অ্যাপ্রুভাল উইন্ডো’ স্থাপনের বিষয়টি সৌদি কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে বলে জানান জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, “যেসব নারী কর্মী কাজ ছেড়ে পালিয়ে যান, সৌদি পুলিশ তাঁদের কোনোভাবেই নিয়োগকর্তার কাছে হস্তান্তর করবে না। নারী কর্মীরা কর্মকাল পূর্ণ করলে তাঁদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট এজেন্সি বহন করবে এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস ও সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে।”

জাহিদ হোসেন বলেন, “ইতিমধ্যে নিয়োগকর্তা পরিবর্তন, নতুন চুক্তি বা নবায়ন ও দেশে ফেরা সংক্রান্ত তথ্যাদি ছাড়া অন্যান্য তথ্যাদি হালনাগাদ করা হয়েছে। অবশিষ্ট তথ্যাদি হালনাগাদের কাজ চলছে।”

কোনো নারী কর্মী মেয়াদ শেষে কাজ করতে চাইলে অবশ্যই চুক্তি নবায়ন করতে হবে এবং এ নবায়ন বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।