হাতিরঝিলের বিজিএমইএ ভবন ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু

প্রাপ্তি রহমান
2019.04.16
ঢাকা
190416_BGMEA_BUILDING_1000.JPG আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে ঢাকার হাতিরঝিলের বিজিএমইএ ভবন ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করে রাজউক। ১৬ এপ্রিল ২০১৯।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ]

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র ভবন আনুষ্ঠানিকভাবে ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবনটি ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করে। কর্মকর্তারা বলছেন, বহুতল এ ভবনটি গুঁড়িয়ে দেয়া হবে।

মঙ্গলবার সকাল ৯টায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে রাজউক কর্মকর্তারা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করেন। বাইরে তখন বুলডোজার ও ভবন ধ্বংসের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি জড়ো করা হয়েছিল। ভবন ঘুরে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন রাজউক কর্মকর্তারা।

“অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবনটি ভাঙার পরিকল্পনা আছে রাজউকের। ভবনটির ভেতরে থাকা অফিসগুলোকে চলে যাওয়ার জন্য প্রথম দুই ঘণ্টা ও পরে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে,” বলেন রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) খন্দকার ওলিউর রহমান।

যদিও ভবনটি ডিনামাইট না কি অন্য কোনো বিস্ফোরকের মাধ্যমে ভাঙা হবে তা বিস্তারিত জানাননি ওলিউর রহমান। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, যে প্রক্রিয়ায় ভবনটি ভাঙা হবে সেটিকে বলা হয় কন্ট্রোলড ডেমোলিশমেন্ট।

এর আগে ২০০৭ সালের ৮ ডিসেম্বর তেজগাঁয়ে অবৈধভাবে তোলা র‍্যাংগস ভবন ভেঙে ফেলা হয়। অপরিকল্পিতভাবে ভবনটি ভাঙার কারণে প্রাণহানি হয় ১৪ শ্রমিকের। বিজিএমইএ ভবন ভাঙায় বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে বলে জানান হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক এ এস এম রায়হানুল ফেরদৌস।

তিনি বলেন, “সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। তবে এখানে বেশ কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে, তেমনিভাবে ম্যানেজমেন্টের বিষয়ও আছে। ভবনটি অপসারণে চীনা প্রকৌশলীদের সহযোগিতা নেওয়া হবে।”

বার বার পেছানোর পরে অবশেষে ভবনটি ভাঙার সিদ্ধান্তে সন্তোষ জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বেনারকে বলেন, “বিজিএমইএ’র বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নয়, বরং আমাদের অবস্থান ছিল তাদের ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে।”

“জবাবদিহিতার অভাব, দায়িত্ব ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতা এবং ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারী প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত দেখভাল করার গাফিলতির পরাকাষ্ঠা ছিল এই ভবন,” বলেন তিনি।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিকেল ৬টার দিকে বিজিএমইএ ভবনটি সিলগালা করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছে, এরপর কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো ক্ষয়ক্ষতির দায় তারা নেবে না।

তবে এখন ভবনটি ভাঙা নিয়ে বিজিএমইএর কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।

“আমাদের যেহেতু আদালতের কাছে মুচলেকা দেওয়া ছিল এবং মহামান্য আদালত আমাদেরকে এ বছরের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন। সেজন্য আমরা ওই সময়ের মধ্যে বিজিএমইএ ভবন ছেড়ে দিয়ে আমাদের দপ্তর উত্তরায় নতুন ভবনে স্থানান্তর করেছি। ১৫ তারিখ থেকে আমরা সেখানে অফিস করছি,” বেনারকে বলেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।

তবে এখনো সেখানে কিছু অফিস থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, “যাদের যাওয়ার ইচ্ছে ছিল তারা সময়ের মধ্যে মালামাল সরিয়ে ফেলেছে। আর যারা ভাবছে যে আরো সময় পাবে তারা এখনো আছে। আমরা আগে বলেছি যে, আমরা আর কখনো সময় চাইব না।”

জানা গেছে, সকালে দুই ঘন্টার মধ্যে অফিস থেকে সবকিছু সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলেও ভবনে থাকা দুটি ব্যাংক তাদের ভল্ট সরাতে পারেনি। পরে বিকেল পর্যন্ত তাদের সময় দেওয়া হয়।

হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় অবস্থিত বিজিএমইএ ভবনটিতে ভূ-গর্ভস্থ দুটিসহ ১৬টি তলা রয়েছে। এর চারটি বিজিএমইএ ব্যবহার করে। বাকিগুলোয় ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আছে। বিজিএমইএ এই ভবনের কয়েকটি তলা আগে বিক্রিও করেছে। তবে আইনি জটিলতায় সেগুলো হস্তান্তর হয়নি। ভবনের ওপরে দুটি তলায় বিলাসবহুল অ্যাপারেল ক্লাব আছে। সংগঠনের সদস্যদের জন্য সেখানে আছে সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম ও রেস্তোরাঁ।

ঢাকার হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন। জমির স্বত্ব না থাকা ও জলাধার আইন লঙ্ঘন করে নির্মাণের কারণে ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেয় আদালত। ৫ এপ্রিল ২০১৯।
ঢাকার হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন। জমির স্বত্ব না থাকা ও জলাধার আইন লঙ্ঘন করে নির্মাণের কারণে ভবনটি ভাঙার নির্দেশ দেয় আদালত। ৫ এপ্রিল ২০১৯।
[মেঘ মনির/বেনারনিউজ

যে কারণে সরলো বিজিএমইএ

ভবনটি নির্মাণের পর থেকে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। তারা জানায়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। এতে উন্মুক্ত স্থান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ ভঙ্গ করা হয়েছে।

সংবাদপত্রে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ছাপা হলে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট ভবনটি অবৈধ ঘোষণা করে। জমির স্বত্ব না থাকা ও জলাধার আইন লঙ্ঘন করায় ভবনটি ভাঙারও নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। আদালত বিজিএমইএ ভবনকে হাতিরঝিল প্রকল্পে ক্যানসারের মতো বলেও উল্লেখ করে।

“বিজিএমইএ ভবনটি সৌন্দর্যমণ্ডিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যানসারের মতো। এ ধ্বংসাত্মক ভবন অচিরে বিনষ্ট না করা হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রামিত করবে,” পর্যবেক্ষণে জানায় আদালত।

রায় ঘোষণার ৯০ দিনের মধ্যে রাজউককে ভবনটি ভেঙে ফেলার নির্দেশও দিয়েছিল আদালত। বিজিএমইএ ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে।

২০১৬ সালের ২ জুন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ওই আপিল খারিজ করে দেয়। আদালত নিজ খরচে ৯০ দিনের মধ্যে ভবনটি ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেয় বিজিএমইএকে। আদালতের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে দু’দফায় মোট ১৩ মাস সময় পেয়েও ভবনটি স্থানান্তরে গড়িমসি করে বিজিএমইএ। সবশেষ গত বছর আর সময় চাওয়া হবে না এই মুচলেকা দিয়ে একবছর সময় পায়।

বিজিএমই ভবন থেকে সব কার্যক্রম সরিয়ে নিয়েছে তৈরি পোশাক মালিকরা। গত ৩ এপ্রিল তারা উঠে গেছে উত্তরার নতুন ভবনে। তবে বেশ কিছু অফিস গতকাল বিকেলে স্থানান্তর হয়।

১৯৯৮ সালে কারওয়ান বাজারের বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ২০০৭ সালে উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। একজন প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন ও অন্যজনের ভবন উদ্বোধনের কারণে বিজিএমইএ কাউকে পাত্তা দিচ্ছিল না বলে অভিযোগ করেন পরিবেশবাদীরা।

প্রধানমন্ত্রীর কথাও শোনেনি মালিকরা

গত ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্তরায় বিজিএমইএর নতুন ভবন উদ্বোধন করেন। তিনি খাল ভরাট করতে নিষেধ করেছিলেন বলে জানান তাঁর বক্তৃতায়।

“বিজিএমইএকে যখন ভবন নির্মাণের জায়গা দিই, আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমি নিজেও ওখানে গিয়েছিলাম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার জন্য। তখন বারবার অনুরোধ করেছিলাম, আপনারা কিন্তু খালটা বন্ধ করবেন না। দুর্ভাগ্য হলো, পরবর্তীতে দেখলাম ওখানে সেই বিল্ডিংটা করা হলো খালের ভেতরেই,” শেখ হাসিনা বলেন।

বর্তমান সরকার অর্ধেক দামে নতুন ভবনের জন্য উত্তরায় ১১০ কাঠা জমি দেয় বিজিএমইএকে। সেই জমিতে দুটি টাওয়ার নির্মাণ করেছে তারা। তেরো তলা ওই ভবনের ছয়তলা পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।