পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের সহায়তা চান উদুর্ভাষীরা
2017.08.09
ঢাকা

উচ্ছেদ রোধ ও পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের মধ্যস্থতা চেয়েছে বাংলাদেশের উর্দুভাষী সংখ্যালঘু মুসলিম বিহারি জনগোষ্ঠী। তবে পুলিশি বাধার মুখে বুধবার ঢাকার জাতিসংঘ কার্যালয়ের সামনে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে পারেননি তাঁরা।
বিহারিদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন বিনা নোটিশে মিরপুর এলাকায় তাঁদের প্রায় ২৫০ বাড়ি-ঘর, দোকানপাট ভেঙে ফেলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো বর্তমানে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
“কোনো উচ্ছেদ নোটিশ ছাড়াই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন গত ২৯ মে থেকে মিরপুর ১১, ১২ এলাকার কয়েকটি স্থানে উর্দুভাষী সংখ্যালঘু পরিবারকে উচ্ছেদ করছে এবং ভাংচুর চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বৈধ জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। আমাদের দাবি, পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ করা যাবে না,” বেনারকে বলেন উর্দু স্পিকিং পিপলস ইয়ুথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট এর সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কু।
উর্দুভাষী মানুষেরা ঢাকার মিরপুর ও আশেপাশের এলাকায় কয়েক দশক ধরে বৈধভাবে বসবাস করছে বলে বেনারকে জানান তিনি।
তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে উর্দুভাষীরা অবৈধ দখলদার। তাই চলমান উচ্ছেদ চলবে।
“আইন অনুযায়ী, উর্দুভাষীরা ঢাকার বিভিন্ন (উদ্বাস্তু) ক্যাম্পে থাকার কথা। কিন্তু তারা ক্যাম্পের বাইরে এসে সিটি করপোরেশনের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে বাড়ি-ঘর, দোকানপাট তৈরি করে ভাড়া দিয়ে টাকা আদায় করছে। আর আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী মিরপুর এলাকায় জনগণের জন্য রাস্তা তৈরি করতে পারছি না,” ঢাকা উত্তর সিট করপোরেশনের প্রধান ভূ সম্পত্তি কর্মকর্তা মো: আমিনুল ইসলাম বেনারকে বলেন।
তিনি বলেন, করপোরেশন থেকে বহুদিন ধরে ওই সকল স্থান খালি করার জন্য তাগাদা দেওয়া হলেও তাঁরা জায়গাগুলো খালি করেনি।
“এই বিহারিরা কয়েক দশক ধরে রাস্তার জায়গা, ফুটপাথের জায়গা এবং আরো সরকারি জমি দখল করে আছে। আমরা ভবিষ্যতে মিরপুর, কালশী ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে আরও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করব,” বলেন আমিনুল।
মুভমেন্টের নেতারা বলছেন, তারা বাধ্য হয়েই পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের মধ্যস্থতা চান যেন এই উচ্ছেদ কার্যক্রম বন্ধ হয়।
“আমরা আমাদের পুনর্বাসনের জন্য জাতিসংঘের মধ্যস্থতা কামনা করছি। কারণ সরকার আমাদের দেখছে না। বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই, আমরা চাই জাতিসংঘ আমাদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করুক,” বলেন ফাক্কু।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ কার্যক্রমের প্রতিবাদে বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতিসংঘ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট ও মানব বন্ধন কর্মসুচি ঘোষণা করে উর্দু স্পিকিং পিপলস ইয়ুথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট। কিন্তু পুলিশ তা পালন করতে দেয়নি।
“বেলা ১২টার দিকে আমরা মিরপুর ১০ নম্বর গোল চক্কর পর্যন্ত মিছিল নিয়ে যাই। এরপর পুলিশ আর আমাদের সামনে যেতে দেয়নি,” বলেন ফাক্কু।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শেরে বাংলা নগর থানার পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বেনারকে বলেন, “এই এলাকা একটি ভিআইপি এলাকা। বিহারিরা এখানে অবস্থান ধর্মঘট ও মানব বন্ধন করতে চেয়েছিল। আমরা করতে দিইনি।”
পরবর্তীতে ১০ নম্বর গোল চক্কর থেকে কয়েকজন নেতা আগারগাঁও এলাকায় অবস্থিত জাতিসংঘ অফিসে গিয়ে একটি স্মারকলিপি জমা দিয়ে আসেন বলে ফাক্কু জানান। তিনি বলেন, জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির অফিসের এক কর্মকর্তা তাদের স্মারকলিপি গ্রহণ করেন এবং তাদের সমস্যাটি ‘দেখবেন বলে’ আশ্বাস দেন।
ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির অফিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, তারা স্মারকলিপিটি সরকারের কাছে পৌঁছে দেবেন।
“এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই,” তিনি বলেন।
বাংলাদেশে উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী
বিহারি হিসেবে পরিচিতি ভারতের বিহার রাজ্যের উর্দুভাষী এই জনগোষ্ঠী দেশ বিভাগের আগে থেকেই স্বল্প সংখ্যায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করলেও মূল স্রোতটি আসে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময়।
এরা বাংলাভাষীদের সঙ্গে মিশত না এবং তারা ছিল পাকিস্তানের কট্টর সমর্থক।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিহারিরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাঁরা পাকিস্তান ফিরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে।
পরবর্তীতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক রেড ক্রিসেন্টের তত্ত্বাবধানে ১৯৭২-৭৪ সালে পাকিস্তান ফিরে যেতে ইচ্ছুক বিহারিদের শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয়। বর্তমানে তারা নিজেদের আটকে পড়া পাকিস্তানি বলেও পরিচয় দেয়। বিহারিরা তাদের ক্যাম্পে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে।
পাকিস্তান সরকার বিহারিদের সেদেশের নাগরিক বলে স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করলেও ইসলামাবাদ এখনো তার নাগরিকদের পাকিস্তানে পুনর্বাসিত করেনি।
তবে ২০০৩ সালের হাই কোর্টের এক রায়ে ১৯৭১ সালের পর জন্মগ্রহণকারী বিহারিদের বাংলাদেশি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের উর্দুভাষী বিহারি জনগোষ্ঠীর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। ২০০৩ সালে পরিচালিত রাবেতা আলম আল ইসলামের এক জরিপে বাংলাদেশে বসবাসকারী বিহারিদের সংখ্যা ২ লক্ষ ৭৫ হাজার বলে জানানো হয়।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক দেড় লক্ষ বিহারির বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ঘোষণা করে ২০০৮ সালে দেওয়া হাই কোর্টের রায়ে দেশে মোট বিহারির সংখ্যা তিন লাখের বেশি বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিহারিদের আনুমানিক সংখ্যা আড়াই লাখের মতো বলে উল্লেখ করা হয়। যার মধ্যে দেশের ১১৬টি ক্যাম্পে ১ লক্ষ ৫১ হাজার ও ক্যাম্পের বাইরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী বিহারিদের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়।