ব্লগার রাজীব হত্যায় দুই আসামির ফাঁসি বহাল, ইমামদের সতর্ক করল আদালত
2017.04.02
ঢাকা

গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজাই বহাল রেখেছে উচ্চ আদালত। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর এ মামলায় আসামিদের দুজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
পাশাপাশি, রায়ের পর্যবেক্ষণে নামাজ পড়ানোর দায়িত্বের বাইরে ইসলাম সম্পর্কে বয়ান দেওয়ার ক্ষেত্রে ইমামদের সতর্ক হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে আদালত।
দেশে অসংখ্য ব্লগার, লেখক, প্রকাশক, ধর্মীয় যাজক, বিদেশি নাগরিকসহ প্রগতিশীলদের হত্যার ঘটনায় মামলাগুলোর মধ্যে এটিই প্রথম রায়।
নিম্ন আদালতের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে রোববার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এ রায় দেয়।
তবে অন্য আসামিদের শাস্তি বাড়ানোর জন্য রাজীবের বাবার করা আবেদনের পক্ষে শুনানিতে কোনো আইনজীবী না থাকায়, সেটি খারিজ হয়ে যায়।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে অংশ নেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আতিকুল হক সেলিম। আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুর রেজাক খান, মো. আহসান উল্লাহ, মোশাররফ হোসেন ও মো. আবদুন নূর দুলাল।
রায়ে বলা হয়, “রাজীব হায়দারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে সন্দেহাতীতভাবে তা প্রমাণিত হয়েছে।”
আসামি যারা
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ।
রায়ে আসামি মাকসুদুল হাসান অনিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১০ বছর সাজার আদেশ দেওয়া হয় আসামি এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া আনসারুল্লা বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জসিমউদ্দিন ছাড়া এসব আসামিদের সবাই বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পরে তাদের বহিষ্কার করা হয়।
সাজাপ্রাপ্ত আট আসামিই কারাগারে রয়েছেন বলে বেনারকে জানান কৌসুলি জহিরুল হক জহির।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নিজের বাসার কাছেই রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পেশায় স্থপতি রাজীব উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ব্লগে ‘থাবা বাবা’ নামে লেখালেখি করতেন।
নিম্ন আদালতের রায়ের পরে শুনানির জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। কারাগারে থাকা আসামিরাও আপিল, জেল আপিল ও সাজা বাতিলের আবেদন করেন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচিত এই মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর শুরু হয়ে এ বছরের ৯ জানুয়ারিতে মামলাটির শুনানি শেষ হয়। এরপর ফেব্রুয়ারি মাসে এবিটি’র সদস্য রানাকে মালয়েশিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পরে সাজা বাতিল চেয়ে ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ চেয়ে আবেদন করেন রানা।
এদিকে রানার আইনজীবী মো. আবদুন নূর সাংবাদিকদের জানান, “হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।”
সকল আসামির সর্বোচ্চ সাজা চায় রাজীবের পরিবার
হাইকোর্টের রায়ে সকল আসামির সর্বোচ্চ সাজা না হওয়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন রাজীবের বাবা ডা. নাজিম উদ্দিন।
তিনি বেনারকে বলেন, “আমার সন্তানকে যারা মেরেছে তারা প্রমাণিত সন্ত্রাসী হওয়া সত্ত্বেও তাদের সবার সর্বোচ্চ সাজা হয়নি।”
অন্য আসামিদের সাজা বাড়াতে এই রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করবেন বলেও জানান।
ইমামদের জন্য সতর্কতা
রাজীব হত্যার রায়ের পর্যবেক্ষণে দেশের ইমামদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছে আদালত। পাশাপাশি তরুণদের সহিংসতা থেকে ফেরানোর জন্য রাষ্ট্রের করণীয় সম্পর্কেও পর্যবেক্ষণ দেয় আদালত।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “মসজিদের ইমামদের দায়িত্ব নামাজ পড়ানো ও ইসলামের আলোকে বক্তব্য দেওয়া। এর বাইরে দেশের প্রচলিত আইনবহির্ভূত কোনো বক্তব্য তারা দেবেন না।”
কেউ কোনো ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে বলে পর্যবেক্ষণে জানায় আদালত।
ইমামদের প্রতি দেওয়া আদালতের পর্যবেক্ষণকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বেনারকে বলেন, “আদালতের এই পর্যবেক্ষণ সমাজের জন্য সতর্কতার নোট হিসেবে কাজ করবে। প্রত্যেক ইমামেরই সতর্কভাবে ইসলামি উপদেশ দেওয়া উচিত।”
তবে আদালতের পর্যবেক্ষণের ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। আমাদের দেখতে হবে আদালত এ বিষয়ে কেবল পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন নাকি নির্দেশনা বা পূর্ণ আদেশ।”
আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, “সাক্ষ্য, প্রমাণ ও আসামিপক্ষের যুক্তি থেকে দেখা যায়, মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানী ছাড়া বাকি আসামিরা মেধাবী ছাত্র। তারপরেও তাঁরা কীভাবে বিপথে গেলেন, আদালত তা খুঁজে পাননি।”
রাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্টদের এখনই বিষয়টি বিবেচনা করার সময় এসেছে জানিয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “শিক্ষা, রাজনীতি, স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস, ধর্মীয় সৌহার্দ্যপূর্ণ ঐতিহ্য—এসব বিষয়ে রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে।”
এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রধানকে আন্তরিকতার সঙ্গে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার আহ্বান জানায় আদালত। এ ক্ষেত্রে দেশের জন্য কাজ করতে আগ্রহী এমন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়।