বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অনন্ত বিজয় হত্যা: দুই বছর পর শুরু হচ্ছে বিচার
2017.05.23
ঢাকা

বাংলাদেশের বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ (৩২) হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পরেও এর আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়নি। তবে এ মামলায় অভিযুক্ত ছয় আসামির বিরুদ্ধে আগামী ২০ জুন অভিযোগ (চার্জ) গঠনের তারিখ নির্ধারণ করেছে আদালত।
মঙ্গলবার মামলার ধার্য তারিখে অভিযোগ গঠনের এই তারিখ নির্ধারণ করে সিলেটের মহানগর দায়রা জজ আদালত।
তবে এদিন দুপুরে ‘অভিযোগ গঠন হয়েছে’ বলে সাংবাদিকদের জানালেও বিকেলে ওই বক্তব্য প্রত্যাহার করেন সে আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মফুর আলী।
এর আগে গত ৮ মে ছয়জনকে অভিযুক্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দেওয়া সম্পূরক অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হয়।
হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ দুই বছর পরেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে নিহতের পরিবার। প্রশ্ন উঠেছে বিচার করার আগ্রহ নিয়েও।
এ প্রসঙ্গে সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু বেনারকে বলেন, “মনে হচ্ছে অনন্ত হত্যার বিচার করতে চাইছে না কিংবা কিছু একটা আড়াল করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।”
পুরো বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগ এনে তিনি বলেন, “এর আগে সিলেটে শিশু রাজন হত্যা কিংবা কলেজছাত্রী খাদিজাকে হত্যা চেষ্টার মতো ঘটনার বিচার দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হয়েছে। ওই সব ঘটনায় যে আন্তরিকতা সরকারের লক্ষ করা গেছে, অনন্ত হত্যার বিচারে সেটা দেখা যায়নি।”
শুধু অনন্ত নয় অভিজিৎ রায়সহ সকল ব্লগার হত্যার বিচার দ্রুত সম্পন্ন করতে তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি বলে তাঁর দাবি।
আসামি পলাতক থাকায় পেছালো অভিযোগ গঠন
আদালত সূত্র জানায়, অভিযোগপত্রে নাম থাকা ছয় আসামির মধ্যে তিন আটক রয়েছেন। এদের বিচারক আকবর হোসেন মৃধার আদালতে হাজির করা হয়েছিল। তবে বাকি তিনজন পলাতক থাকায় অভিযোগ গঠন পিছিয়েছে।
ছয়জন আসামির উপস্থিতেতে অভিযোগ গঠন করা হবে বলে আদালত ২০ জুন তারিখ ধার্য করে। এই সময়ের মধ্যে পলাতকদের গ্রেপ্তারে সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশকে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত।
এই মামলায় গ্রেপ্তার থাকা ব্যক্তিরা হলেন; কানাইঘাটের পূর্ব ফালজুর গ্রামের মান্নান রাহি ওরফে মান্নান ইয়াহিয়া ওরফে ইবনে মইন (২৪), ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশিদ আহম্মেদ (২৪) ও নগরের রিকাবিবাজারের বাসিন্দা সাফিউর রহমান ফারাবী ওরফে ফারাবী সাফিউর রহমান (৩০)।
পলাতক তিন আসামি হলেন; সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ফালজুর গ্রামের আবুল হোসেন ওরফে আবুল হুসাইন (২৫), খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমেদ (২৭) ও সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বীরেন্দ্রনগর (বাগলী) গ্রামের হারুন অর রশিদ (২৫)।
অনন্ত হত্যাকাণ্ডের একদিন পর তার বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ বাদী হয়ে সিলেট মহানগরের বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাত চার দুর্বৃত্তকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। পরে মামলার তদন্তভার সিআইডিতে স্থানান্তর হয়। এরপরেই আসামি শনাক্ত করে সিআইডি।
হতাশ পরিবার
অন্তত হত্যা তদন্তে পরিবারের সঙ্গেও তদন্ত কর্মকর্তারা তেমন কোনো যোগাযোগ করেনি বলে অভিযোগ করেন দেবাশীষ দেবু।
তিনি বলেন, “পরিবার জানেও না অভিযোগপত্রে কাদের আসামি করা হচ্ছে, কাদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়াই পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে। তবু আশা করি, অভিযোগপত্র যেহেতু দেওয়া হয়েছে, বিচার দ্রুত হবে।”
সত্যতা নিশ্চিত করে এ বিষয়ে নিহত অনন্ত বিজয়ের ভাই রত্নেশ্বর দাশ বেনারকে বলেন, “পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা আসলে খুবই হতাশ হয়ে পড়েছি। জানি না আদৌ বিচার পাব কিনা। অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।
অবিশ্বাসের দর্শন: একটি বই, তিনটি হত্যা
পেশায় ব্যাংকার হলেও অনন্ত বিজয় দাশ বস্তুবাদ ও যুক্তিবাদ নিয়ে প্রিন্ট ও অনলাইন মাধ্যমে লেখালেখি করতেন। তিনি বিজ্ঞানবিষয়ক বই লেখার পাশাপাশি সম্পাদনাও করতেন। বিজ্ঞানবিষয়ক ছোটকাগজ যুক্তি নামে একটি পত্রিকা নিয়মিত সম্পাদনা করতেন তিনি। সিলেটে পরিচালিত বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অনন্ত।
মানবতা এবং যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৬ সালে তিনি মুক্তমনা র্যাশনালিস্ট অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন।
অনন্ত বিজয়ের প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়’, সৈকত চৌধুরীর সাথে যৌথভাবে প্রবন্ধ সংকলন ‘পার্থিব’, সিদ্ধার্থ ধর এর সাথে যৌথভাবে অনূদিত ‘জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ (মূল: ফ্রান্সিসকো জে. আয়াল)।
তাঁর সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো ‘ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা’ ও অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর এর যৌথভাবে লেখা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’।
অবিশ্বাসের দর্শন বইটির সাথে সংশ্লিষ্টদের ওপর ২০১৫ সালে মৌলবাদী জঙ্গিদের চারটি আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন তিনজন আর মারত্মকভাবে আহত হন চার।
মৌলবাদী জঙ্গিদের আক্রমণে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির অন্যতম লেখক অভিজিৎ রায় খুন হন ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, মারাত্মকভাবে আহত হন বিজ্ঞান লেখক বন্যা আহমেদ। ১২ মে খুন হন সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশ, ৩১ অক্টোবর খুন হন বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের প্রকাশক ফয়সল আরেফীন দীপন। একই দিনে আরো দুইজন লেখকের সাথে বইটির প্রথম প্রকাশক শুদ্ধস্বর প্রকাশীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলকে আক্রমণ করে মারাত্মকভাবে আহত করে জঙ্গিরা।