কবি ও প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যা: সন্দেহের শীর্ষে জঙ্গিগোষ্ঠী
2018.06.13
ঢাকা

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কাকলদি গ্রামে কবি, প্রকাশক ও রাজনীতিবিদ শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যার ঘটনায় সন্দেহের শীর্ষে আছে জঙ্গিগোষ্ঠী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহ, মুক্তমনা এই লেখককে হত্যার মাধ্যমে নতুন করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে কোনো উগ্রপন্থী সংগঠন। একই সঙ্গে নিহতের পরিবারে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকার অভিযোগও খতিয়ে দেখছে তারা।
মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বুধবার বেনারকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা মূলত দুইটি দিক নিয়ে তদন্ত করছি। প্রথমত, লেখালেখির কারণে জঙ্গিরা তাঁকে হত্যা করল কিনা, দ্বিতীয়ত তাঁর পারিবারিক কোনো ঝামেলা ছিল কিনা।”
জঙ্গি সংশ্লেষসহ প্রতিটি তথ্য খতিয়ে দেখার কথা জানিয়ে সিরাজদিখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, “নিহতের পরিবারেও দ্বন্দ্ব থাকতে পারে।”
যদিও গত মঙ্গলবার বাচ্চুর দ্বিতীয় স্ত্রী আফসানা জাহান গণমাধ্যমকে বলেন, “মৌলবাদী কোনো গোষ্ঠীই তাঁকে হত্যা করেছে।” একইদিন অজ্ঞাত পরিচয়ের চার হামলাকারীকে আসামি করে তিনি সিরাজদিখান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
আর “নিজেদের বাবাকে কেন আমরা লোক দিয়ে খুন করাব?” প্রশ্ন রেখে বাচ্চুর প্রথম স্ত্রীর কনিষ্ঠ সন্তান দূর্বা জাহান বেনারকে বলেন, “এমনটা জানানো হয়েছে বলেই পুলিশ হত্যার কারণ হিসেবে পারিবারিক দ্বন্দ্বের সূত্র খুঁজছে।”
এর আগে নিহতের স্বজন এবং এসপি জায়েদুলের বরাত দিয়ে বাংলাদেশি একাধিক গণমাধ্যম জানায়, নিহত বাচ্চুর ঢাকায় দুটি বাড়ি থাকলেও তিনি গ্রামে দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে থাকতেন।
বেনারকে দূর্বা বলেন, “পুলিশ ও মিডিয়াকে অনেক ভুল ইনফরমেশন দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে আমরা নাকি বাবার দুটো বাড়ি জোর করে লিখিয়ে নিয়েছি, অথচ তাঁর ঢাকায় কোনো বাড়ি ছিল না। আমরা এখনো ভাড়া বাসায় থাকি।”
“অথচ মানুষজন বলছে, আমরা নাকি সব জমিজমা দখল করতে চাচ্ছিলাম,” জানিয়ে দূর্বা বলেন, “পরিবারের কারও আসলে এখন কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা নেই। তবুও এসব কথা কোথা থেকে আসছে তা বুঝতে পারছি না।”
তাঁর সৎ বোন আঁচল সাংবাদিকদের বলেন, “যখন ধারাবাহিকভাবে মুক্তমনা ও নাস্তিক ব্লগারদের হিটলিস্ট প্রকাশ করে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন আমার বাবার নাম ১১ নম্বরে ছিল।” বাচ্চু নিয়মিত মৃত্যুর হুমকি পেতেন বলেও উল্লেখ করেন সদ্য এসএসসি উত্তীর্ণ এই বালিকা।
এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বরাত দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, “লেখালেখির ধরন বা প্রোফাইল থেকে ধারণা করা যায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বা আনসার আল ইসলামের টার্গেট হতে পারেন তিনি।”
“তবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ব্যবহৃত হাতে তৈরি গ্রেনেডের (আইইডি) ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটা জেএমবির (পুরোনো) কাজ,” যোগ করেছে তারা।
এ ছাড়া জঙ্গিবাদ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা সিটিটিসি’র এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন লিখেছে, “যে গোষ্ঠীই হোক, জঙ্গিরা হয়তো নতুন করে আবার তাদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে। এটি হয়তো শাহজাহান বাচ্চুকে দিয়েই শুরু হলো।”
কোণঠাসা জঙ্গি সংগঠন দুটি মিলে গেছে কিনা তাও সিটিটিসি খতিয়ে দেখছে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়।
মুন্সিগঞ্জের এসপি বেনারকে বলেন, “জেলা ও থানার পুলিশ এবং র্যাব ছাড়াও ঢাকা থেকে আসা কাউন্টার টেররিজম, অ্যান্টি টেরোজিম ইউনিট এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ), ইন্টেলিজেন্সসহ চার-পাঁচটি সংস্থা একসঙ্গে তদন্ত করছে।”
সিরাজদিখান থানার ওসি বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন ইউনিট বিভিন্ন ভাবে তদন্ত করছে।”
প্রসঙ্গত কবি শাহজাহান বাচ্চু বিশাকা প্রকাশনীর কর্ণধার ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
গত সোমবার সন্ধ্যায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাঁর নিজের গ্রামেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
গ্রেপ্তার নেই, জিজ্ঞাসাবাদ চলছে
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি এখনো। তবে হত্যার শিকার হওয়ার আগে বাচ্চু যার দোকানে বসে ছিলেন, সেই আনোয়ার হোসেন সর্দারসহ একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এসপি জায়েদুল বেনারকে বলেন, “তিনি ওয়াইফকে (দ্বিতীয় স্ত্রী) বলতেন আমাকে মেরে ফেলবে। তবে কে বা কারা মেরে ফেলবে তা কখনো বলেননি। তার ‘ওয়াইফ’ বলতেন পুলিশের কাছে যাও, তবে তিনি আমাদের কাছে আসেননি।”
“মৃত্যুর পাঁচ-ছয় দিন আগেও নাকি একবার বলেছেন আমাকে মেরে ফেলা হবে। তবে ফোনে না, ফেসবুকে হুমকি পাওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি,” জানিয়ে এসপি আরও বলেন, “তাঁর ফেসবুক ঘেঁটে অবশ্য তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি।”
অন্যদিকে আফসানা সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি দীর্ঘদিন থেকেই যেকোনো সময় হত্যার শিকার হতে পারেন—এমন আশঙ্কার কথা বলতেন। মাঝেমধ্যেই ভারতে বন্ধুদের কাছে যেতেন। কখনো ভারতে থেকে যাওয়ার কথাও বলতেন।”
মুক্তচিন্তার ওপর বর্বর আক্রমণ
শাহজাহান বাচ্চুকে ‘সাংবাদিক’ ও ‘ব্লগার’ উল্লেখ করে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) এই হত্যাকাণ্ডে দায়ীদের খুঁজে বের করতে বাংলাদেশ সরকারকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে বলেছে। এ ঘটনাকে ‘মুক্তচিন্তার ওপর বর্বর আক্রমণ’ বলছে তারা।
গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ফ্রান্সভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানের এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরের প্রধান ডেনিয়েল ব্যাস্টার্ড বলেন, “ধর্মীয় সহনশীলতা এবং নাস্তিকতার পক্ষে কথা বলাই বাচ্চুকে জিহাদি গোষ্ঠী ও মুসলিম মৌলবাদীদের লক্ষ্যবস্তু করে তোলে।”
সুন্নি চরমপন্থীদের কাছ থেকে কয়েক বছর ধরে পাওয়া মৃত্যুর হুমকির কারণে তিনি প্রায়ই অবস্থান পরিবর্তন করছিলেন জানিয়ে ডেনিয়েল বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষ সাংবাদিক ও ব্লগার, যারা বাচ্চুর মতো মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন; তাঁদের রক্ষায় অবশ্যই রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হতে হবে।”
ডেনিয়েল আরও বলেন, “আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি এ জাতীয় অপরাধগুলোয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের প্ররোচনাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টার আহ্বান জানিয়েছি।”
বাংলাদেশে গত এক দশকে প্রায় এক ডজন ব্লগার মৌলবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন এবং অনেকেই দেশ ছেড়ে থেকে পালিয়ে গেছেন উল্লেখ করে আরএসএফ আরও জানায়, প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬০তম।