শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যার সন্দেহে আরও দুজন ‘ক্রসফায়ারে’

জেসমিন পাপড়ি
2018.09.07
ঢাকা
180907_Bachchu_1000.jpg শাহজাহান বাচ্চু হত্যার প্রতিবাদে বগুড়ায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ। ১৩ জুন ২০১৮।
নিউজরুম ফটো

ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সিগঞ্জে মুক্তমনা কবি ও প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যায় সন্দেহভাজন দুই জঙ্গি পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে। নিহত কাকা ওরফে বোমা শামীম এবং এখলাসুর রহমান নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সদস্য বলে দাবি করেছে পুলিশ।

পুলিশের দাবি, নিহত বোমা শামীম ওরফে কাকা ছিল প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুকে হত্যার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’, আর এখলাস ছিল অস্ত্রের জোগানদাতা।

জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মাকসুদা লিমা বেনারকে জানান, বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ২টার দিকে শ্রীনগর উপজেলার কেসি রোডে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে এই দুজন নিহত হয়।

“নিহত দুজনই শাহজাহান বাচ্চু হত্যার সাথে জড়িত ছিল বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে,” সাংবাদিকদের জানান মুন্সিগঞ্জ পুলিশের জেলা ইন্টেলিজেন্স অফিসার মো. নুরুল ইসলাম।

এই দুজনসহ বাচ্চু হত্যার সন্দেহভাজন তিনজনের মৃত্যু হলো। এর আগে গ্রেপ্তার হওয়ার তিন দিনের মাথায় ২৮ জুন আবদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। তাকেও বাচ্চু হত্যায় জড়িত প্রধান সন্দেহভাজন বলে দাবি করেছিল পুলিশ। ওই হত্যার পর পুলিশ অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে মামলা করেছিল।

তবে বাচ্চু হত্যার সন্দেহভাজন আসামীদের একের পর এক বিচার ছাড়াই মেরে ফেলার ঘটনায় সন্তুষ্ট নন নিহতের পরিবার বা তাঁর ঘনিষ্ঠজনেরা।

“বাবা হত্যার বিচার একটা বিচারিক ব্যবস্থায় হোক, সেটাই চেয়েছিলাম। তাহলে অন্তত জানতে পারতাম কেন, কীভাবে তারা আমার বাবাকে মেরেছিল,” বেনারকে জানান নিহত বাচ্চুর মেয়ে দুর্বা জাহান।

দুর্বা জাহান আক্ষেপ করে বলেন, “বাবার সন্দেহভাজন হত্যাকারীরা ধরা পড়লে কিংবা নিহত হলেও আমরা কিছুই জানতে পারি না। সাধারণ মানুষের মতো আমিও সকালে টেলিভিশনে জানলাম বাবার দুই হত্যাকারী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে।

“এর আগে আরেক আসামি আটক এবং নিহত হওয়ার ঘটনাটিও টেলিভিশনে জেনেছিলাম। মামলার তদন্ত বা অগ্রগতি বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি,” বলেন দুর্বা।

প্রসঙ্গত, গত ১১ জুন বিকেলে সিরাজদিখান উপজেলার কাকালদী মোড়ে দুটি মোটরসাইকেলে করে আসা চার ব্যক্তি শাহজাহান বাচ্চুকে (৫৭) গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনায় অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছিল।

শাহজাহান বাচ্চু বিশাকা প্রকাশনীর মালিক ছিলেন। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া ‘আমাদের বিক্রমপুর’ নামের একটি অনিয়মিত সাপ্তাহিক পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

মূল পরিকল্পনাকারী শামীম

গত​ জুনে বন্দুকযুদ্ধে আবদুর রহমান নিহত হওয়ার পর পুলিশ জানিয়েছিল, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও দুজন জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

সে সময় আবদুর রহমানকে প্রধান সন্দেহভাজন বলে দাবি করা হলেও শুক্রবার মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম সংবাদ ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “প্রকাশক বাচ্চু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল বোমা শামীম ওরফে কাকা। আর সকল অস্ত্রের যোগানদাতা ছিল এখলাস। তারা দুজনেই পুরোনো জেএমবির সদস্য।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, শামীম বোমা তৈরিতে দক্ষ বলে সংগঠনে তার নাম হয়েছিল ‘বোমা শামীম’। তার বিরুদ্ধে থানায় পাঁচটি ডাকাতির মামলা রয়েছে।

পুলিশ সুপার বলেন, “বাচ্চুকে হত্যার জন্য এখলাস বালুর চরে বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করে এবং সকল আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন স্থান থেকে ওই ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। হত্যার পর সে নিজেই অস্ত্রগুলো গাজীপুরে আব্দুর রহমানের কাছে পৌঁছে দেয়।”

পুলিশ জানায়, বন্দুকযুদ্ধে নিহত শামীম (৪০) কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানার লৌক্ষা গ্রামের আব্দুল রশিদের ছেলে। আর এখলাছ (৩২) জামালপুরের খামার পাড়া গ্রামের মো. গিয়াস উদ্দিনের ছেলে।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার জায়েদুল বলেন, জঙ্গিরা শ্রীনগর এলাকায় ডাকাতি করতে আসছে খবর পেয়ে রাতে মহাসড়কের দুটি স্থানে চেক পোস্ট বসায় পুলিশ। রাত ১টার দিকে হাষাড়া কেসি রোডের চেক পোস্টের সামনে দুটি মোটর সাইকেলে করে চারজনকে আসতে দেখে পুলিশ তাদের থামার সংকেত দেয়।

“এসময় মোটরসাইকেল আরোহীরা পুলিশের দিকে হাতবোমা ও গুলি ছুড়তে থাকে। পুলিশও পাল্টা গুলি করলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মোটর সাইকেল থেকে দুইজন রাস্তায় ছিটকে পড়ে; অপর মোটর সাইকেলে থাকা দুজন পালিয়ে যায়,” জানান পুলিশ সুপার।

পরে গুলিবিদ্ধ দুজনকে উদ্ধার করে শ্রীনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ষোষণা করেন বলে জানান তিনি।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, এই অভিযানে পুলিশ সদস্য এএসআই মাসুদ, এসআই ইলিয়াস এবং কনস্টেবল তামিম আহত হয়েছেন। তাদের মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

ঘটনাস্থল থেকে ১১টি হাতবোমা, একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি, দুটি রাম দা এবং জঙ্গিদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

বিচার না হওয়ায় সন্দেহ

প্রকাশক বাচ্চুর ঘনিষ্ঠদের একজন শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবিন আহসান বেনারকে বলেন, “বিচার না করে অপরাধীদের মেরে ফেললে এ ধরনের হত্যা কমবে না। যে দুজন মারা গেল, তারা আসলেই অপরাধী কি না, সেটা প্রমাণই হয়নি। তাহলে কীভাবে বলা হচ্ছে, তারা বাচ্চু হত্যার সাথে জড়িত?”

“দেশে আইন ও আদালত আছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় অপরাধীদের ফাঁসি হলে মানুষ জানত যে, তারা অপরাধ করেছে,” বলেন তিনি।

ঢাকার নামকরা ওই প্রকাশক জানান, “বাচ্চু হত্যার তিন মাসের মধ্যে বিচার বা রহস্য উদঘাটন ছাড়াই অভিযুক্তদের সরিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। এতে প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ল কি না, সেই সন্দেহ প্রবলভাবে থেকে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।