পুলিশের নজরদারির মধ্যে শুরু একুশে বইমেলা

জেসমিন পাপড়ি
2018.02.01
ঢাকা
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন শেষে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধন শেষে বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
সৌজন্যে বাসস

প্রতিবছরের মতো এবারও ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিনে ঢাকায় শুরু হয়েছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা। তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে এমন বইয়ের ওপর পুলিশ নজরদারি বাড়ানোর কথা বলায় লেখক, প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে এ বইমেলার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনও করেন তিনি। আগামী ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

পুলিশের নজরদারি করার সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়ে লেখক, প্রকাশক ও বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, এটি সংবিধানের মূলনীতি বাক স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এটা মুক্ত চিন্তার চর্চার ক্ষেত্রেও বড় অন্তরায় বলে তাঁরা মত দেন।

“পুলিশ আগাম কোনো বইয়ের ওপর নজরদারি করতে পারে না। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট লেখক মুনতাসির মামুন।

বইয়ের ক্ষেত্রে এমন বিধিনিষেধ দেওয়ায় মুক্ত চিন্তার ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন লেখক এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তাঁর মতে, এটা লেখক ও প্রকাশকদের শৃঙ্খলিত করারই নামান্তর।

যদিও বাংলা একাডেমি বলছে, তারা লেখক প্রকাশকদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। তবে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন যেকোনো বইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট লেখক-প্রকাশকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।

গত মঙ্গলবার বইমেলার স্থান পরিদর্শনের পর পুলিশ কমিশনার লেখক ও প্রকাশকদের জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে এমন বই প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান। বাংলা একাডেমির গঠিত কমিটি এবং ডিএমপি এবং গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা এ ধরনের বই শনাক্ত করার কাজ করবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তবে পুলিশ ও বাংলা একাডেমির সমন্বয়ে এমন কোনো পৃথক কমিটি গঠনের পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। যদিও মেলার নীতিমালা মেনে চলার অনুরোধ করেছেন তাঁরা।

“ওটা পুলিশের কথা। বাংলা একাডেমির প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে আমাদের তথ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন নতুন বই আসে। সেগুলো আমাদের কর্মীরা বইয়ের ধরন অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করেন। এরপর সেসব বইয়ের প্রচার হয়। এখানে বই পড়ে দেখার কথা আমাদের নীতিমালায় নেই,” বেনারকে বলেন একুশে গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্যসচিব ড. জালাল আহমেদ।

তিনি জানান, “আমাদের একটা কমিটি আছে, যার কাজ হলো গ্রন্থমেলার নীতিমালা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা দেখাশোনা করা। তাতে বাংলা একাডেমি, প্রকাশক, পুলিশ, কপিরাইট ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকে। তারা পুরো মেলা পরিদর্শন করেন। কোনো অভিযোগ আসলে দেখেন।”

“যদি নীতিমালা পরিপন্থী বই, পাইরেটেড বা নোট বই থাকে সেগুলো ওই কমিটি দেখে। প্রয়োজন বোধ করলে কমিটি অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী বাংলা একাডেমি ব্যবস্থা নেয়, প্রয়োজনে পুলিশের সহায়তা নেয়,” বলেন ড. জালাল আহমেদ।

বাংলা একাডেমির এই পরিচালক বলেন, “আমরা লেখকদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। সৃষ্টিশীলতায় বিশ্বাস করি।”

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া কবি সাহিত্যিকদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া কবি সাহিত্যিকদের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮।
সৌজন্যে বাসস

কয়েক বছর ধরে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন বইয়ের বিষয়ে নজর রাখছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে ২০১৫ সালে মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যার পরের বছর থেকে সংবেদনশীল বিষয়ের কিছু বই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় মেলা কর্তৃপক্ষ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন বই প্রকাশ না করতে লেখক ও প্রকাশকদের সতর্কও করে দেওয়া হয়।

সে বছর অক্টোবরে উগ্রপন্থীরা অভিজিতের বইয়ের প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যা করে। একই দিন আরেক প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের কার্যালয়ে ঢুকে এর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা। টুটুলের সঙ্গে থাকা কবি তারেক রহিম ও লেখক রণদীপম বসুও আহত হন।

মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবার অভিযোগে ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় একটি প্রকাশনা সংস্থা নিষিদ্ধ এবং প্রকাশককে আটক করা হয়েছিল। একই সঙ্গে ওই প্রকাশনীর বেশ কয়েকটি বই জব্দ করা হয়।

ওই ঘটনার প্রতিবাদ করায় শ্রাবণ প্রকাশনীকেও মেলায় নিষিদ্ধ করেছিল বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ। পরে লেখক-প্রকাশকদের প্রতিবাদের মুখে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে তারা।

“ধর্ম অবমাননার বিষয়ে আইন রয়েছে। অভিযোগ আসলে সেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। কিন্তু অভিযোগ আসার আগেই পুলিশ বই তদারকির কাজ করতে পারে না। বাংলা একাডেমিও পারে না। এমন কিছু হলে একাডেমি পুলিশকে জানাতে পারে বা কোর্টে যেতে পারে,” বলছিলেন লেখক শাহরিয়ার কবির।

তবে এই ধরনের বিধিনিষেধ কেবল ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে লেখার জন্য জানিয়ে তিনি বলেন, “আজ পর্যন্ত হিন্দু বা খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে কারও শাস্তি হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। অথচ মোল্লারা এসব ধর্মের বিরুদ্ধে হরহামেশা বাজে মন্তব্য করে থাকে। এটা অত্যন্ত ক্ষোভের বিষয়। সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।”

 

মেলার পরিসর বেড়েছে

এবারের মেলার পরিসর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় বলে জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। তিনি জানান, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে প্রায় পাঁচ লাখ বর্গফুট এলাকায় ৪৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭১৯টি ইউনিট বরাদ্দ করা হয়েছে এবারের গ্রন্থমেলায়।

বাংলা একাডেমিসহ ২৪টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৫টি প্যাভিলিয়ন। রয়েছে ১৩৬টি স্টল নিয়ে লিটল ম্যাগাজিন কর্নার। শিশুকিশোরদের জন্য বিনোদন ও শিক্ষামূলক অঙ্গসজ্জায় রয়েছে শিশুকর্ণারও।

মেলার সময় বাড়িয়ে ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।