একুশে বইমেলা: ভয় ও চাপের কবলে লেখক-প্রকাশক
2019.02.08
ঢাকা

ইসলামী জঙ্গিদের ভয় এবং রাষ্ট্রের চাপে বাংলাদেশের লেখক ও প্রকাশকেরা ‘সেলফ-সেন্সরশিপ’-এর ফাঁদে আটকে আছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, এই পরিস্থিতি চলমান অমর একুশে গ্রন্থমেলায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিগত কয়েক বছরে মৌলবাদীদের হাতে বহু লেখক-প্রকাশক হত্যা, গ্রেপ্তার ও মেলায় পুলিশ দিয়ে বই নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ শঙ্কা বাড়িয়েছে উল্লেখ করে প্রকাশক রবীন আহসান বেনারকে বলেন, “সেলফ সেন্সরশিপ লেখক-প্রকাশকদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে।”
২০১৭ সালে প্রকাশিত ইসলামী মৌলবাদীদের চাপে দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া লেখক তসলিমা নাসরিনের ‘সকল গৃহ হারালো যার’ বইটি দেখিয়ে প্রকাশক রবীন জানান, ঝামেলা এড়াতে তিনি এটির প্রায় ৪০ পৃষ্ঠা ছেঁটে ছাপিয়েছিলেন।
ওই পৃষ্ঠাগুলোতে ধর্ম বিষয়ক বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদ ছিল বলে জানান রবীন।
“মেলার পরিসর ও জৌলুস বাড়লেও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বা মুক্তচিন্তা হারিয়ে গেছে। আগের সেই বৈচিত্র্য নেই। এখন আর সরকার বা ধর্মের সমালোচনা করে বা ভিন্নমতের কোনও বই ছাপা হচ্ছে না,” বলেন রবীন আহসান।
“সেলফ সেন্সরশিপ হচ্ছে মনন জগতের এক ধরনের আত্মহত্যা। যার প্রাদুর্ভাব এখন অনেক বেড়েছে,” মন্তব্য করে কথা সাহিত্যিক জাকির তালুকদার বেনারকে বলেন, “লেখায় বৈচিত্র্য না এলে বইমেলায় বৈচিত্র্য আসার কোনও সুযোগ নেই।”
“আতঙ্কের মধ্যে থেকে ভালো বই লেখা বা প্রকাশ—দুটোই কঠিন,” বলেন রবীন। আর জাকির তালুকদারের দাবি, “বড় পত্রিকা এবং বড় প্রকাশকদের মধ্যে এটা বেশি কাজ করে। কারণ তাদের বিনিয়োগ বেশি, হারানোর ভয়ও বেশি।”
তবে লেখকদের “সেলফ-সেন্সরশিপের জন্য বাংলা একাডেমিকে দায়ী করা যাবে না” বলে মনে করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।
তাঁর মতে, “আমার মনে হয় না যে জঙ্গিদের হুমকি বা পুলিশের নজরদারির জন্য লেখক-প্রকাশকদের অসুবিধা হচ্ছে। সম্ভবত ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁরা এমনটা করছেন।”
নিষ্প্রাণ বই মেলা
পহেলা ফেব্রুয়ারি গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে “এই মেলা শুধু বই কেনাবেঁচার মেলা নয়, এটা বাঙালির প্রাণের মেলা” বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য করলেও প্রকাশক রবীনের দাবি, “মেলার আসল যে জিনিস, সেই বইয়ের মধ্যেই এখন আর কোনও প্রাণ নেই।”
বইয়ে প্রাণ সঞ্চালনের জন্য তর্ক-বিতর্কের বা বহুমত চর্চার সুযোগ থাকা দরকার— উল্লেখ করে রবীন বলেন, “স্বৈরাচারী এরশাদ, এমনকি খালেদা জিয়ার আমলেও এই প্রাণ ছিল। কিন্তু এখন সরকার বিরোধী কোনো বই লিখতে বা ছাপাতে আমরা ভয় পাই। ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই বললেই চলে।”
জাকির তালুকদার বলেন, “সব সরকারই মুক্তচিন্তার বিরোধী। বর্তমান সময়ে হিংস্র মৌলবাদীদের দোহাই দেওয়ার সুযোগ এসেছে। হুমকি যে নাই, তা-ও না। তবে সরকার চাইলে সেটি দমন করতে পারে।”
অবশ্য ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া মেলা শুরুর আগে বলেন, “পুলিশের কর্মকর্তা–সদস্যরা সতর্ক আছেন এবং কাজ করে যাচ্ছেন।”
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে জঙ্গি হামলায় নিহত হন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়। এর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মেলা থেকে বের হওয়ার পথে প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপরও হামলা চালানো হয়।
এছাড়া ‘নাস্তিক’ আখ্যা পাওয়া ব্লগ লেখক আহমেদ রাজীব হায়দারকে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মিরপুরে তার বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। যার মাধ্যমে ধারাবাহিক চোরাগোপ্তা হামলায় ভিন্নমতাবলম্বী লেখক-প্রকাশক নিধন শুরু করেছিল উগ্রবাদীরা।
সর্বশেষ গত বছরের ১১ জুন মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় জঙ্গি হামলায় নিহত হন বিশাকা প্রকাশনীর কর্ণধার কবি শাহজাহান বাচ্চু।
“এসব বিবেচনায় বইমেলা চলাকালে এখন প্রগতিশীল ও মুক্তমনা লেখকদের কিছুটা সতর্ক থাকতে হয়,” বেনারকে বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলী আর রাজী।
মূলত একই কারণে বইমেলায় কোন ধরনের বই আসছে সেটি নিয়ে কয়েক বছর ধরে বেশ সজাগ আয়োজক কর্তৃপক্ষ। এবারও লেখক-প্রকাশকদের সতর্ক করেছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী।
দেশের শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, “বিতর্কিত বই মেলায় আনা হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
মেলা শুরুর আগের দিন ৩১ জানুয়ারি ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত করে এমন কোনো বই প্রকাশকেরা বইমেলায় আনতে পারবেন না।”
এর আগে ২০১৬ সালের বইমেলায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করেছিল একাডেমি এবং প্রকাশক শামসুজ্জোহা মানিককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
তবে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মতে, শুধু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী বইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে একাডেমি। কারণ সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে কারো ধর্মকে আঘাত করার সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে রবীন বলেন, “মতান্তরই বুদ্ধিবৃত্তির সৌন্দর্য, যার অভাবে আমরা জাতি হিসেবে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি।”
মেলায় নেই খালেদার জীবনীগ্রন্থ
গত নভেম্বরে প্রকাশিত বই ‘বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ হার স্টোরি’ গ্রন্থমেলায় নেই। দি ইউনিভার্সেল একাডেমির প্রকাশক ও পরিচালক মো. শিহাব উদ্দীন ভূঁইয়া বেনারকে স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কথা জানান।
“এই বইটি প্রকাশ করার কারণে এবার আমাদের দোকান বরাদ্দ পেতেই সমস্যা হয়েছে। যে কারণে বইটি মেলায় রেখে আর ঝামেলা বাড়াতে চাইনি,” বলেন তিনি।
শিহান আরও জানান, ২৭ বছরে প্রায় ১২শ বই প্রকাশ করে তাঁর সংস্থাটি এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েনি।
কারাগারে থাকা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এই জীবনীগ্রন্থের লেখক মাহফুজ উল্লাহ বেনারকে বলেন, “বিষয়টি শুনে আমি প্রকাশককে ঝুঁকি নিতে নিষেধ করেছি।”
“প্রজাতন্ত্র চুরি করে যে সরকার টিকে থাকে, সেই সরকারের আমলে সবই ঘটতে পারে। তারা এখন লেখার স্বাধীনতাও কেড়ে নিতে চাইছে,” বলেন এই প্রবীণ সাংবাদিক।
এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও একুশে গ্রন্থমেলা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ বেনারকে বলেন, “বইটি মেলায় আনা যাবে না- এমন কোনো নির্দেশনা বাংলা একাডেমি অন্তত ইউনিভার্সেলকে দেয়নি।”
জাগৃতি আছে, নেই অভিজিতের বই
অভিজিৎ হত্যার বছরেই, ৩১ অক্টোবর ঘাতকের আঘাতে প্রাণ হারান তাঁর বন্ধু ও প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন। তাঁর মৃত্যুর পর চতুর্থবারের মতো তাঁর প্রতিষ্ঠান জাগৃতি মেলায় অংশ নিয়েছে।
দীপনের স্ত্রী রাজিয়া রহমান জলি বেনারকে বলেন, “এবারের মেলায় জাগৃতি ৫৫-৬০টি নতুন বই আনবে।”
তবে দীপনের প্রকাশ করা অভিজিৎ রায়ের বই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ বা ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ এখন আর পাওয়া যায় না। দীপন খুন হবার পর বইগুলো আর প্রকাশ করেনি জাগৃতি।