ভারতীয় পণ্য বয়কট কর্মসূচিতে বিএনপি’র সমর্থন

আহম্মদ ফয়েজ
2024.03.20
ঢাকা
ভারতীয় পণ্য বয়কট কর্মসূচিতে বিএনপি’র সমর্থন ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহবানে ঢাকায় গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) বিক্ষোভ। ৮ মার্চ ২০২৪।
[বেনারনিউজ]

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলমান ভারতীয় পণ্য বয়কট বা ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযানে সমর্থন দিয়েছে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর নেতৃত্বে চলমান সরকার বিরোধী আন্দোলনে থাকা ৬৩টি রাজনৈতিক দল ও জোট।

বুধবার ঢাকায় দলের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই সমর্থনের কথা জানান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের বাজারে ভারতের বড় ধরণের অংশীদারত্ব রয়েছে।  সরকারি হিসেবে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় সাত গুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারত থেকে প্রায় ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ, বিপরীতে বাংলাদেশ ২০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ভারতে।

সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্রই ইন্ডিয়া আউট ক্যাম্পেইন নিয়ে উত্তাল।  ভারতীয় পণ্য বর্জন করে জনগণ প্রতিবাদ জানাচ্ছে।  রাজধানীতে মিছিল-সমাবেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হচ্ছে। ”

“এটা জনগণের কাছে পরিষ্কার যে, গত তিন দশক আওয়ামী লীগ ভারতের সহযোগিতায় নির্বাচনের নামে তামাশা করে আসছে।   গত ৭ জানুয়ারি বিনা ভোটে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে ভারতের সমর্থনে,” যোগ করেন তিনি।

রিজভী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বর্জনের যে ঢেউ দৃশ্যমান তাতে মনে হয় দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে।  সুতরাং জনগণের দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিসহ ৬৩টি গণতন্ত্রকামী দল এবং দেশপ্রেমিক জনগণ ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করছে।

মূলত, বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়েছে-এমন অভিযোগে নির্বাচন পরপরই সামাজিক মাধ্যমে ভারতীয় পণ্য বয়কট বা ইন্ডিয়া আউট প্রচারাভিযান শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা। ইতোমধ্যে ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) ও ইউটিউবে বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলন শেষে রিজভী নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ভারত থেকে নিজের জন্য কিনে আনা কাশ্মীরি শাল ছুড়ে ফেলে দেন।

এ সময় রিজভী আজ থেকে ভারতের কোনো পণ্য ব্যবহার করবেন না বলে জানান।  দলীয় কর্মীদেরও একই আহ্বান জানান তিনি। পরে নেতাকর্মীরা শালটিতে আগুন ধরিয়ে দেন।

সংবাদ সম্মেলনে রিজভী বলেন, “গত নির্বাচনে জনগণ দেখেছে, ভারতীয় কূটনীতিকরা বাংলাদেশে এসে বলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তারা স্থিতিশীলতা চান।  তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার চান না।”

তিনি বলেন, ভারতের জনগণের সঙ্গে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। তবে আমাদের আপত্তি ভারতের শাসকদের পলিসি, নীতি নিয়ে।

“এটা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়।  বাংলাদেশের অধিকার হারা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন।  ভারতীয় পণ্য বর্জনকে আমরা যৌক্তিক মনে করি।  সর্বহারা জনগণের এই আবেগকে আমরাও ধারণ করি।  ভারতীয় পণ্য বর্জন মানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারকে বর্জন,” সংবাদ সম্মেলনে জানান তিনি।

রিজভীর এই বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত নাকি দলের সিদ্ধান্ত এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বেনারকে বলেন, “দেখুন এই প্রতিবাদটা দেশের অধিকারহারা মানুষের আন্দোলন।  বিএনপি সাধারণ মানুষকে ধারণ করে। তাই এটিকে আমার বক্তব্য ও দলের অবস্থান দুই-ই বলতে পারেন।”

প্রকাশ্য হচ্ছে বিএনপির ভারত বিরোধিতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির ভারত বিদ্বেষ নিয়ে অতীতে অনেক আলোচনা হলেও গত সাধারণ নির্বাচনের পর দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা নানা সময়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই ভারত বিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন।

গত ১৭ মার্চ কক্সবাজার জেলায় আয়োজিত বিএনপির একটি অনুষ্ঠানে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ভারতের নাম উচ্চারণ না করেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশটির প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

তিনি বলেন, “৭ তারিখ প্রমাণ করেছে, আজকের এই ডামি আমি সরকারের সঙ্গে আর যাই হোক দেশের মানুষ এদের সাথে নেই।  তাহলে এদের সাথে কারা আছে? এদের যে মন্ত্রী যারা আছে—এরা তাদের নিজেদের কথা দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে এদেশের জনগণ এদের সাথে নেই বরং এদের সাথে রয়েছে কোনও একটি দেশ।”

“এরা এই দেশের জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে না, তারা নিজেদের সেই দেশের ক্রীতদাসে পরিণত করেছে। এই ডামি আমি সরকার হচ্ছে সেই পার্শ্ববর্তী দেশের ক্রীতদাস সরকার,” বলেন তারেক রহমান।

তারেক রহমানের এই বক্তব্যের একদিন পর ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল মঈন খান বলেন, “বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়-বিএনপিও সেই নীতিতে বিশ্বাস করে। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সহযোগিতায় আমরা দেশকে অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীন করতে পেরেছি।  আজকে দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারেও আমরা বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সহযোগিতা কামনা করছি।”

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যদি একদলীয় শাসনের জন্য বন্ধু রাষ্ট্রের সহায়তা চায়, আমরা বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য বন্ধু রাষ্ট্রের সহায়তা চাই।

তিনি বলেন, ক্ষমতাসীনরা বলছেন, বন্ধুরাষ্ট্রের সহযোগিতায় তারা ক্ষমতায় এসেছেন।  তাদের কথায়ই প্রতীয়মান হয়, জনগণের ভোটে তারা ক্ষমতায় আসেননি।

সম্পর্ক বৈরিতার পর্যায়ে নেয়া সমীচীন নয়: কাদের

গত শনিবার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন কমিটির দ্বিবার্ষিকী সম্মেলনে যোগ দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গায়ে পড়ে ভারতের সঙ্গে তিক্ততা তৈরি করে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। ইন্ডিয়া আউট বলে সম্পর্ককে বৈরিতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সমীচীন নয়।

তিনি বলেন, যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকে তখন একটি মহল ভারতবিরোধী প্রচারণা চালানো শুরু করে।

এ সময় তিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রসঙ্গে বলেন, “ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো বলেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আলোচনা করে ৬৮ বছরের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে।  আমি এই কৃতিত্ব দিবো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদীকে।  দীর্ঘ দিনের অবিশ্বাস ও সন্দেহের দেয়াল তারা ভেঙ্গে দিয়েছেন।”

নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ভারত বিরোধিতা: বিশেষজ্ঞ

সহজে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য ভারতের বিরোধিতা করা সহজ দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বেনারকে বলেন, “বিএনপি হয়তো নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা ঢাকতে সেই পথটিই বেছে নিয়েছে।  তবে আমি বলবো এগুলো বর্তমান বিশ্বে তেমন কোনও প্রভাব তৈরি করতে পারবে না।”

তিনি বলেন, “আমাদের দেশের জনগণকে আমার এতোটা বোকা মনে হয় না যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি প্রচারণা দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিবে।  কিন্তু এটা সত্য যে, বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতা করে জনপ্রিয়তা পাওয়া সহজ।”

তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত আরো বিচার-বিশ্লেষণ করে বক্তব্য দেয়া।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।