ঢাকাসহ সংলগ্ন পাঁচ জেলার ৩১৯টি অবৈধ ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে ধ্বংসের নির্দেশ
2022.03.01
ঢাকা

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী চার জেলায় ৩১৯টি চিহ্নিত অবৈধ ইটভাটা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে ধ্বংস করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে আদেশ দিয়েছে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ।
বেসরকারি সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ এর পক্ষে দায়ের করা জনস্বার্থ রিট আবেদন নিষ্পত্তিকালে মঙ্গলবার সরকারের প্রতি এই আদেশ দেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
রিটকারী সংগঠনের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আদালত বলেছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে ঢাকা, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলায় ৩১৯টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর জেগে ঘুমাচ্ছে। এখন আর ঘুমানোর সময় নেই।”
তিনি বলেন, অবৈধ ইটভাটার কারণে ঢাকার বায়ুমান বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে গেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব অবৈধ ইটভাটা। এগুলো এখনই বন্ধ করতে হবে।
মনজিল মোরশেদ জানান, “আদালত আজ আদেশ দিয়ে বলেছেন, সব অবৈধ ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে ধ্বংস করে আগামী ৫ এপ্রিল আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।”
“যদি পরিবেশ অধিদপ্তর সেই কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে পরবর্তীতে আদালতের আদেশ অমান্য করার দায়ে পুনরায় আদালতের আদেশ চাওয়া হবে,” যোগ করেন ওই আইনজীবী।
পরিবেশ অধিদপ্তরের আইনজীবী আমাতুল করিম আদালতকে জানান, “ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলায় যে ৩১৯টি অবৈধ ইটভাটা চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ৯৫টি ইতোমধ্যে বন্ধ করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের মাত্র তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা ছাড়া ইটভাটা বন্ধের জন্য অভিযান পরিচালনা করতে পারে না।
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী পাঁচ জেলার ৩১৯টি অবৈধ ইটভাটার তথ্য হাইকোর্টকে সরবরাহ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আদালতের নির্দেশ সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। আমরা সব সময়ই আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে থাকি।”
তিনি বলেন, “অবৈধ ইটভাটা পরিবেশের জন্য মারাত্নক সঙ্কট সৃষ্টি করে–এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে থাকে।”
জিয়াউল হক বলেন, “ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটার চিমনি থেকে নির্গত ধোঁয়া অন্যতম কারণ। শীত মৌসুমে যখন বৃষ্টি কমে আসে সেসময়ে ইট পোড়ানো হয়। সেকারণে বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পায়। তবে বায়ুমান উন্নয়নের জন্য আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে থাকি।”
২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের যৌথ গবেষণা অনুসারে দেশে মোট সাত হাজার ৯০২টি ইটভাটা রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে দুই হাজার ৪৮৭টি ঢাকা বিভাগে অবস্থিত।
দেশে বিভিন্ন দালানকোঠা, অবকাঠামো নির্মাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ইটের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে বলে জানানো হয় ওই গবেষণায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৩ সালের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকা শহরের বাতাসে যে পরিমাণ ক্ষুদ্র কণা থাকে তার শতকরা ৫৮ ভাগ আসে ইটভাটার কারণে। এতে বলা হয়, দেশের সকল ইটভাটাকে পরিবেশবান্ধব করা গেলে প্রতি বছর সাত হাজার ৯৩ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, তিন হাজার ৪৩৪ টন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধুলিকণা, প্রায় এক হাজার ৮৭৫ টন সালফার-ডাই-অক্সাইড পরিবেশ থেকে অপসারণ করা সম্ভব হবে।
পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ২০১৯ সালের তুলনায় বর্তমানে ইটভাটা থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধুলিকণার পরিমাণ ৫৮ ভাগ থেকে নেমে প্রায় ৪৭ ভাগ হয়েছে।
প্রতিবছর মূলত নভেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দেশের ইটভাটাগুলো চালু থাকে। এর কারণ এই পাঁচ মাস বাংলাদেশে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। ভাটাগুলোর চিমনি পরিবেশবান্ধব নয়। ফলে পোড়ানো কয়লা, কাঠের ছাই ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। নষ্ট হয় কৃষিজমি এবং দূষিত বায়ু গ্রহণ করে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন।
ঢাকার বায়ু দূষণ নিয়ে গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালাম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “ঢাকা শহরে বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হলো অবৈধ ইটভাটা, যদিও ইটভাটা থেকে দূষণের মাত্রা ২০১৩ সালের চেয়ে কমে এসেছে।”
তিনি বলেন, “প্রথাগত অবৈধ ইটভাটা থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা যেগুলো আমরা পার্টিকুলেট ম্যাটার বলে থাকি সেগুলো নির্গত হয়। এছাড়াও কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত হয়, যেগুলো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক হুমকি।”
অধ্যাপক সালাম বলেন, “বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী বায়ু দূষণের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রতি বছর বাংলাদেশে ৯৭ হাজার থেকে দেড় লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এ ছাড়া প্রতি বছর আমাদের দেশের শতকরা পাঁচ ভাগ জিডিপি নষ্ট হয়।”
তিনি বলেন, “আজকে অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে আদালত সরকারকে যে আদেশ দিয়েছেন, সেটি বড় নজির হয়ে থাকবে।”
উল্লেখ্য, বৈশ্বিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘আইকিউ এয়ার’ এর তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণে বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান প্রায়ই শীর্ষে থাকে। মাঝেমধ্যে এ অবস্থানে কিছুটা হেরফের হয়।