যৌনপল্লি থেকে মুক্ত দুই নারী, মুক্তি চান অনেকেই
2017.04.18
ঢাকা

কিশোর বয়সে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লিতে বিক্রি হয়ে যাবার দীর্ঘ দিন পর সন্তানসহ মুক্তি পেলেন দুই নারী। তাঁদের একজন মৌসুমি, যৌনপল্লিতে আছেন প্রায় দুই যুগ, অন্যজন আট বছর ধরে থাকা নাজমা।
চারটি শিশু সন্তানসহ এই দুইজনের মুক্তির জন্য দৌলতদিয়ায় যৌনজীবীদের সংগঠন মুক্তি মহিলা সমিতির (এমএমএস) সহায়তায় মূল ভূমিকা পালন করেছেন মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম খোকন, সমাজকর্মী ফজলুল করিম এবং কলেজ ছাত্রী সুরাইয়া আখতার বৃষ্টি।
ঢাকা থেকে প্রায় একশ কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ি জেলা। সেখানকার গোয়ালন্দ পৌরসভায় দৌলতদিয়া ঘাটের কাছাকাছি রেললাইনের পাশেই অবস্থিত দেশের বৃহত্তম এই যৌনপল্লি। উল্লেখ্য, দেশে এখন যৌনপল্লির সংখ্যা ১১টি।
গত শনিবার দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে বেনারের সঙ্গে মৌসুমির কথা হয়।
“নানার বাড়ি গেছলাম। বাচ্চারা খেলতেছিল। আমিও তাদের সাথে বাইর হইছলাম। তখন একজন ফুসলায়া এখানে নিয়া আসে। সে আমাকে বিক্রি করি থুয়ে গেছল,” বেনারকে জানান মৌসুমি।
নিষিদ্ধ পল্লিতে যৌনদাসী হিসেবে তাঁকে বিক্রি করে দেবার সময় তার বয়স ছিল ১২ বছর, এখন ৩৬।
“ছুকরি (যৌনদাসী) হিসাবে ছিলাম ১২/১৩ বছর। হাজেরা বানু (সর্দারনি) এখান থেকে চলি যাওয়ার সময় স্বাধীন করে দিছে,” বেনারকে বলেন মৌসুমি।
দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনভাবে পেশা চালিয়ে গেলেও মৌসুমি মন থেকে ভালোবাসতে পারেননি এই পেশাকে।
তিনি বলেন, “আমি এখান থেকে যাইতে পারলেই বাঁচি। বাচ্চাগুলাকেও বাঁচাইতে চাই। দুইটা ছেলে। এদেরকে নিয়া চিন্তা।”
অবশেষে তিন স্বেচ্ছাসেবীর উদ্যোগে গত ১৬ এপ্রিল ওই যৌনপল্লি থেকে দুটি শিশুপুত্রসহ মুক্তির পথ পেয়েছেন মৌসুমি। তাঁর পরবর্তী ঠিকানা গাজীপুরের শ্রীপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি আশ্রয় কেন্দ্র।
বাড়িওয়ালার কাছে মৌসুমির দায়দেনা ছিল ৪৩ হাজার ৫৭০ টাকা। বাড়ির মালিক ইয়াকুব ১২ হাজার ৫৬০ টাকা মাফ করে দেন। বাকি ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করেন তিন স্বেচ্ছাসেবী খোকন, ফজলুল এবং সুরাইয়া।
একই সঙ্গে মুক্ত হলেন নাজমা
নাজমার গল্পটাও প্রায় একই রকম। প্রায় ৮ বছর পল্লিতে ছিলেন। কেউ একজন বিক্রি করে গিয়েছিল ওই যৌনপল্লিতে। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে মুক্তির অপেক্ষায় ছিলেন দীর্ঘকাল।
নাজমার ঋণ ছিল না। কিন্তু বের হবার পর বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে আশঙ্কা ছিল। অবশেষে ওই তিন স্বেচ্ছাসেবী ও এমএমএস এর সহায়তায় তাঁকে বিকল্প জীবনের নিশ্চয়তা দিয়েছে শিশুপল্লি প্লাস।
যৌনপল্লি থেকে বেরিয়ে বেনারের কাছে নাজমার প্রথম অভিব্যক্তি, “আজ নতুন জীবন পাইলাম।”
অনেকে আটকে আছেন দায়দেনায়
যৌনপল্লি থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে যেতে চাইলেও অনেকে আটকে আছেন দায়দেনা ও পল্লির বাইরে জীবন যাপনের অনিশ্চয়তায়।
নাজমা ও মৌসুমির বিদায় পর্ব চলার সময় আলেয়া নামে এক নারী তাঁর পক্ষে যৌনপল্লি ছেড়ে যাবার উপায় নেই জানিয়ে বেনারকে বলেন, “যাইতে চাই; কিন্তু উপায় নাই। আমার তিন ছেলে। দুইটা শিশু; বড়টার বুদ্ধিশুদ্ধি নাই। বুড়ো বাবা-মা আছে। তাদেরকে দেখতে হয়। ভাই আছে, পাগল। সারাক্ষণ নেশার মধ্যে থাকে।”
আলেয়া স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন জানিয়ে বলেন, “স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর অনেক কিছু করছি। রেলের প্লাটফরমে পিঁয়াজি বেঁচতাম। অনেক দেনা ছিল। শোধ করতে পারি না। পরে (যৌনজীবী হিসেবে) নাম লেখায়া ভিতরে চলে আসি।”
পল্লি ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নে আরেক যৌনজীবী ফরিদা বললেন, “আমার অনেক ঝামেলা। ৭০ হাজার টাকা দিতে হবে। এই জায়গার ইনকাম এইখানেই শেষ।”
তাঁর মেয়ে পিংকির বিয়ে হয়েছিল কিন্তু সংসার না টেকায় বাধ্য হয়ে মেয়েকেও এই পেশায় আসতে হয়েছে বলে জানান ফরিদা। কিন্তু অসুস্থতার জন্য মেয়ের পক্ষে আয় করা সম্ভব হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, “পারতেছে না। বারো মাস জ্বর থাকে। অনেক ডাক্তার দেখাইলাম; ভালো হয় না।”
“আমার মুক্তি নাই। ঘর ভাড়া দেই, কিস্তি আছে,” বলেন ফরিদা।
পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই
স্বেচ্ছাসেবী ফজলুল করিম জানালেন যৌনকর্মীদের সেবা দেয়ার জন্য কিছু এনজিও থাকলেও এখান থেকে হবার পর পুর্নবাসন করার কেউ নেই।
তিনি বলেন, “গতবার এমএমএস কর্মকর্তাদের সহায়তায় ব্রোথেল ঘুরে তিনজন পেয়েছিলাম যারা বেরিয়ে আসতে চায়। এদের মধ্যে মৌসুমির দায়দেনা কম থাকায় টাকার দায়িত্ব আমরা নেই। এইটা প্রথম কেস। বাকি দু’জনের দায়দেনা অনেক, ওদের ব্যবস্থা এরপর করব। এদের আশ্রয়ের জন্য শ্রীপুরে শিশু পল্লির সমাজকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।”
এমএমএস এর সিনিয়র প্রজেক্ট অফিসার আশরাফুজ্জামান বেনারকে বলেন, “শিশু পল্লি প্লাস-এ আশ্রয় নিশ্চিত হওয়ার পর মৌসুমির মতো নাজমাকেও এখান থেকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেই আমরা। নাজমার ঋণ না থাকায় কাজটা সহজ হয়েছে।”
শিশু পল্লির সমাজকর্মী মো. আবু সামা জানালেন, “মুক্ত দুই মা এবং তাদের চার সন্তান অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধাসহ তিন বছর এখানে নিরাপদে থাকতে পারবেন। তারা কাজ শিখবেন এবং পারিশ্রমিক হিসেবে তিন বছর পর তাদের হাতে একটি সঞ্চিত অর্থ দেওয়া হবে, যাতে তারা নিজেদের মতো জীবন শুরু করতে পারেন।
এই উদ্ধার প্রক্রিয়ার অন্যতম নায়ক রেজাউল করিম খোকন বলেন, “আমি ছোটখাটো কিছু করার চেষ্টা করি। ১৬ বছর ধরে পথশিশু কুড়ানোর কাজে আছি। তাদের আশ্রয় ও জীবিকা দেওয়ার চেষ্টা করি।”
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের চেষ্টায় ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এই পল্লি থেকে ১৫৭ জন যৌনকর্মীকে উদ্ধার করা হয়েছে। এমএমএস এর ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী দৌলতদিয়া পল্লিতে ১২০৩ জন যৌনজীবীর বাস। এর মধ্যে ৩৮ জন ছিল ছুকরি বা যৌনদাসী। শিশু (১৮ বছরের নিচে) যৌনকর্মীও রয়েছে ওই পল্লিতে, যদিও এর সুনির্দিষ্ট হিসেব নেই। এমএমএস এর হিসেবে এই পল্লিতে যৌনজীবীদের সন্তানের সংখ্যা ৮৮৫।