বহুমাত্রিক বঞ্চনায় বেড়ে উঠছে যৌনপল্লির শিশুরা
2017.04.28
ঢাকা

আপডেটঃ ২৯ এপ্রিল ২০১৭, ইস্টার্ন টাইম বিকেল ০৩.৩০
পরীক্ষার হলে শিক্ষক হঠাৎ একজন শিক্ষার্থীকে দাঁড়াতে বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “রুবিনা (ছদ্মনাম) তোমার বাবার নাম কী?” পরীক্ষা চলাকালে বাবার নাম জানতে চাওয়ার প্রয়োজন ছিল না। ছাত্রীটি বুঝে নিল পরীক্ষার মধ্যেই তাকে আরেক কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে।
সবাইকে শুনিয়ে জোর গলায় ছাত্রীটি বলল, “আমি আমার বাবার নাম জানি না। আমার মা দৌলতদিয়া ব্রোথেলে একজন যৌনজীবী। তার কষ্টার্জিত অর্থে আমি বাইরে এসে লেখাপড়া করছি। এতে আপনার কোনো অসুবিধা আছে স্যার?”
“বলেই বসে পড়েছিলাম। রাগে, দুঃখে, ঘৃণায় আমার শরীর কাঁপছিল। কান্না চেপে রাখতে পারছিলাম না। মনে হয়েছিল পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে যাই। কিন্তু হার মানিনি। পরীক্ষা দিয়েই বেরিয়েছি,” বেনারের কাছে এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল রুবিনা।
রুবিনাদের জয়ী হওয়ার সংগ্রামে এ রকম ছোটবড় অনেক অভিজ্ঞতা। সকল তিক্ত অভিজ্ঞতা পেছনে ফেলে যৌনপল্লিতে জন্ম নেওয়া অন্তত ১১ জন শিশু উচ্চ মাধ্যমিক পর্ব অতিক্রম করে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছে বা করতে যাচ্ছে।
তাদের এই অর্জনের পেছনে তাদের মায়েদের যেমন অবদান, তেমনি অবদান রয়েছে কর্মজীবী কল্যাণ সংস্থা (কেকেএস) নামে একটি বেসরকারি সংগঠনের। কেকেএস-এর আশ্রয় কেন্দ্রে এসব শিশুদের আশ্রয় এবং সংগঠনটির স্কুলেই তাদের লেখাপড়া।
এর আগে যৌনজীবীদের মেয়ে শিশুরা বড় হয়ে সবাই মায়ের পেশা বেছে নিত। এখন কিছুটা পরিবর্তন এসেছে বলে বেনারকে জানালেন কেকেএস এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হারুন উর রশিদ।
তিনি বলেন, “অনেক শিশু এখন লেখাপড়া করছে। অনেকের অনেক বড় স্বপ্ন। কিন্তু জীবনের মূলধারায় প্রবেশে তাদের অনেক বাঁধা। সমাজ তাদেরকে সহজভাবে গ্রহণ করে না।”
গত ১৫ এপ্রিল রাজবাড়ি জেলার দৌলতদিয়া যৌনপল্লি এবং নিকটবর্তী এলাকা সরেজমিনে ঘুরে যৌনজীবী মায়ের সন্তানদের নানাবিধ বঞ্চনার চিত্র পাওয়া গেছে।
পরিচয় সংকট
এই পল্লির সন্তানদের বাবার পরিচয় নিয়ে প্রতি পদে পদে সংকট। বিয়ের ক্ষেত্রে, চাকরি পেতে, বিদেশ গমনে, সম্পত্তি রক্ষায় সর্বত্র তারা হয়রানির শিকার হয়। যৌনপল্লিতে যে সবার জন্ম হয়েছে এমনটি নয়। বেশ কয়েকজন পাওয়া গেল যাদের জন্মের অনেক পরে মা যৌনজীবী হয়েছেন। কিন্তু তারপরও ওই মায়ের সন্তানেরা পরিচয় সংকটে ভুগছে।
“আমি তখন ছোট। বাবা মারা যাওয়ার পর মা রাস্তায় মাটি কাটার কাজ করত। পরে একজন ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে মাকে দৌলতদিয়ার পল্লিতে রেখে গিয়েছিল,” জানালেন শুভ্রা (ছদ্মনাম)।
আরেকজন বললেন, “মাকে খুব নির্যাতন করত বাবা। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।”
বাবার পরিচয় জানার পরও এদের অনেকেই সংকটে আছেন। এম এ পাস করার পর শুক্লার (ছদ্মনাম) বিয়ে হয়। তার শরীরে হেপাটাইটিস বি-পজিটিভ। অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু পরিচয়ের কারণে চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে পারছেন না বলে তিনি জানালেন।
“পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তা আমার পাসপোর্ট সংক্রান্ত নথিতে নেতিবাচক প্রতিবেদন দিয়েছে। কারণ হিসেবে পিতৃ পরিচয় এবং ঠিকানা নিয়ে বিভ্রান্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে,” জানালেন শুক্লা।
তিনি বলেন, ভোটার আইডিতে মায়ের ঠিকানা লেখা আছে দৌলতদিয়া যৌনপল্লি। যৌনপল্লি ছেড়ে দিয়ে তিনি এখন মেয়ের কাছেই আছেন। এসবি রিপোর্টে বলা হয়েছে ‘ঠিকানা মেলেনি’।
স্নেহ-মমতাহীন পরিবেশে বেড়ে ওঠা
ব্রোথেলের শিশুদের পড়ার পরিবেশ নেই। ছোট ছোট রুম। সেখানে মায়েদের যৌন ব্যবসা। অলি-গলিতে মদের দোকান, নাচানাচি ও চিৎকার চেঁচামেচি। ঘরে জায়গা না পাওয়ায় রাস্তায়, ফুটপাতে কিংবা ‘মাসি’র ঘরে দিনাতিপাত করে যৌনজীবী মায়ের অবোধ শিশুরা।
“ঘর ভাড়া, খাওয়াদাওয়া, বৃদ্ধ মায়ের ভরণপোষণ, সাজসজ্জা—অনেকরকম ব্যয়। কাস্টমার না ধরলে একদিনও চলে না। ঘরে কাস্টমার নিলে বাচ্চার পড়ার জায়গা দিতে পারি না,” বেনারকে বললেন বিথি আক্তার।
“খদ্দের না পেলে আয় নেই। দিনে ৪০০ টাকা ঘর ভাড়া দিতে হয়; দায়দেনা অনেক। বাচ্চার জন্য আলাদা ঘর নেব কীভাবে?” বলেন পূজা পাণ্ডে।
দেশের মোট ১১ টি যৌনপল্লির মধ্যে দৌলতদিয়া অন্যতম। সেখানে প্রায় দেড় হাজার যৌনজীবীর বাস। বর্তমানে প্রায় তিন শ’ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। তবে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। কেকেএস এর জরিপ অনুযায়ী যৌনপল্লির মাত্র ১১ শতাংশ শিশু মাধ্যমিক পাস করছে। বাকি ৮৯ শতাংশ ঝরে পড়ছে।
“২০১০ সালে ব্রোথেলের ৮ জন ছেলে ও ১৯ জন মেয়ে কেকেএস শিশু বিদ্যালয় শেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। তাদের মধ্যে মাত্র তিনজন ২০১৫ সালে এসএসসি পাশ করেছে। বাকিদের লেখাপড়া আগেই বন্ধ হয়ে গেছে,” জানালেন কেকেএস কর্মকর্তা হারুণ উর রশিদ।
সংগঠনটির উদ্যোগে এবং সেভ দি চিলড্রেনের সহায়তায় যৌনজীবীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে মুক্তি মহিলা সমিতি (এমএমএস)। তিন বছরের শিশুরা দিনের বেলা এমএমএস-এর আশ্রয়ে থেকে বর্ণ পরিচয় লাভ করে। এরপর মেয়ে শিশুরা আশ্রয় পায় কেকেএস-এর সেফ হোমে। সেখানে থেকে কেকেএস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে পারে।
ছেলে শিশুদের অবস্থা বেশ খারাপ
কিছু মেয়ে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেলেও ছেলেদের শিক্ষিত হওয়ার নজির নেই বললেই চলে। কারণ হিসেবে জানা গেল, এখানে ছেলেদের জন্য সেফ হোম নেই। তাদের জায়গা রাস্তায়। এদের অনেকেই মাদকাসক্ত হয়ে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
যৌনপল্লি থেকে বেরিয়ে অদম্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন আসিফ (ছদ্মনাম)। বিএ পাস করার পর ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে তার চাকরি হয়েছে। দৌলতদিয়ায় তার নিকটজনদের কাছে ঠিকানা সংগ্রহ করে ঢাকায় তার সঙ্গে কথা বলেন বেনার প্রতিবেদক।
আসিফ বললেন, “আত্ম পরিচয় গোপন করে সমাজে টিকে থাকা সহজ নয়। আমার মতো কজন সেটা পারবে—যদি সমাজ আশ্রয় না দেয়। জীবনের ভাগাড়ে আমাদের জন্ম; সেখানেই আমাদের শেষ গতি।”
এমএমএস নির্বাহী পরিচালক মর্জিনা বেগম জানান, “যৌনজীবীর সন্তানদের শিক্ষাজীবন অন্য দশটা শিশুর মতো সহজ নয়। অনেক কষ্ট করতে হয় ওদের। লেখাপড়া শিখলেও সরকারি চাকরি পায় না। এদের দিকে সরকারের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।”
কেকেএস এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক ফকির আব্দুল জব্বার জানান, যৌনপল্লিতে যারা বাস করে তাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সেখানকার ছেলেদের জন্যও একটি সেফ হোম করা জরুরি।