জাতীয় বাজেট: কালো টাকা সাদা করার অবাধ সুযোগ

কামরান রেজা চৌধুরী
2020.06.11
ঢাকা
200611_Budget-1000.jpg জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে অধিবেশ কক্ষের দিকে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ১১ জুন ২০২০।
[ফোকাস বাংলা]

শতকরা ১০ ভাগ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। এই কর দিয়ে অপ্রদর্শিত নগদ টাকা, ব্যাংকে রক্ষিত অর্থ, জমি, দালানকোঠাসহ অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বৈধ করা যাবে।

বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এই ঘোষণা দেন। তবে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে ‘দুর্নীতি সহায়ক’ বাজেট দেয়া হয়েছে। এতে সমাজে দুর্নীতি উৎসাহিত হবে।

জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সংসদ ভবনের কেবিনেট কক্ষে অনুষ্ঠিত বিশেষ মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ২০২০-২১ অর্থবছরের এই বাজেট অনুমোদন করা হয়। পরে সংসদে এই বাজেট উপস্থাপনের জন্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সম্মতি দেন।

করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত সংখ্যক সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় বাজেট অধিবেশন।

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “কোনো কোনো ক্ষেত্রে করদাতার রিটার্ন দাখিলে অজ্ঞতার কারণে তাঁদের কিছু অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ক্রটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। এ অবস্থায় করদাতাদের আয়কর রিটার্নের এই ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ প্রদান এবং অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমি আয়কর অধ্যাদেশে দুটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাব করছি।”

মুস্তফা কামাল বলেন, “প্রথমত দেশের আইনে যাই থাকুক না কেন, আগামী পয়লা জুলাই ২০২০ থেকে ৩০ জুন ২০২১ এর মধ্যে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাগণ আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত জমি, বিল্ডিং (দালানকোঠা), ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড, বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর প্রদান করলে আয়কর কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।”

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বিধানসমূহ কার্যকর হলে অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থ প্রবাহ বাড়বে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং রাজস্ব আদায় বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে সরকার জনগণকে বলছে ‘তোমরা দুর্নীতি করো’। সারা বছর যে অবৈধ টাকা আয় হবে, বছর শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে গিয়ে কিছু কর দিয়ে তা বৈধ করা যাবে।”

“আমরা বার বার বলে আসছি বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া উচিত নয়। এর মাধ্যমে সমাজে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়া হয়। তাই বলব, এটি একটি দুর্নীতি সহায়ক বাজেট,” বলেন ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, “অবৈধ আয় বৈধ করতে কর মাত্র ১০ ভাগ। আর বৈধ আয়ের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ ভাগ। এটি বৈষম্যমূলক এবং সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।”

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা কলো টাকা সাদা করতে দেয়ার এই ব্যবস্থার বিরোধী। এটি নৈতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক; সব দিক বিবেচনায় অন্যায়।”

দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি বলেন, “যিনি বৈধ আয় করছেন, তিনি সর্বোচ্চ ২৫ ভাগ কর দেবেন। আর যারা অবৈধ আয় করবেন তাঁরা মাত্র ১০ ভাগ কর দেবেন—এটা কেমন করে হয়? এটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”

এদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করারও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী জানান, কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা আগামী অর্থ বছরে পুঁজিবাজারে অর্থ বিনিয়োগ করে তার ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে আয়কর বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবে না।

কোভিড মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকা

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যে কোনো জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে।

সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যখাতে মোট ৪১ হাজার ২৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী, যা প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৭ শতাংশের বেশি।

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসকে ‘সঠিকভাবে মোকাবেলা ও এর অর্থনৈতিক প্রভাব দৃঢ়তার সাথে কাটিয়ে ওঠার’ স্বার্থে এবার গতানুগতিক বাজেটের ধারা থেকে কিছুটা সরে এসেছেন তিনি।

এবারের বাজেটে অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৭৮ হাজার ৫২ জন, মারা গেছেন এক হাজার ৪৯ জন।

রপ্তানি পণ্যে উৎসে কর হ্রাস

সকল ধরনের পণ্য ও সেবা রপ্তানি খাত কোভিড-১৯ এর কারণে বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী তৈরি পোশাকসহ সব ধরনের পণ্যের রপ্তানি মূল্যের ওপর উৎসে কর এক শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির প্রধান কল্পনা আখতার বেনারকে বলেন, “করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের মাত্র দুই শতাংশ হারে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, তারা নিয়মিত বেতন দেবেন, কর্মী ছাঁটাই করবেন না।”

“কিন্তু আমরা দেখলাম গত সপ্তাহে কারখানা মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হলো, তাঁরা কর্মী ছাঁটাই করবেন। তাদের কিছু করার নেই। ফলে তাঁরা তাঁদের কথা রাখছেন না। সরকারের উচিত সেদিকে নজর দেয়া।”

বাজেটের কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয়

প্রস্তাবিত বাজেটে পুরুষদের করমুক্ত আয়সীমা আড়াই লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ এবং নারী ও ৬৫ বছরের বেশিদের করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার কথা বলা হয়েছে।

বৈধ পথে অর্থ প্রেরণ উৎসাহিত করতে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই শতাংশ প্রণোদনা অব্যহত রাখা হবে।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সিগারেটসহ তামাকজাত বিভিন্ন পণ্যের উপর শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে বলেন, তামাক ব্যবহার কমানো এবং রাজস্ব আয় বাড়াতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের আকার ৫ লাখ ১ হাজার ৫৭৭ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থ বছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এই বাজেট পাশ হওয়ার পর তা আইনে পরিণত হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।