সরকারের পুরো মেয়াদে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
2019.06.13
ঢাকা

আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদের পুরো সময় জুড়ে থাকছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। এ বছর পয়লা জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করলে টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলা হবে না।
এত দিন ফ্ল্যাট কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও এবার নতুন করে জমি যুক্ত করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেট উত্থাপনকালে প্রস্তাবিত অর্থ বিলে এমন সুযোগের দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল।
তবে এ ধরনের প্রস্তাবনাকে ‘নজিরবিহীন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অর্থনীতিবিদেরা।
২০১৯-২০ সালের প্রস্তাবিত অর্থ বিলে বলা হয়েছে, আয়কর অধ্যাদেশে অথবা দেশের অন্য কোনো আইনে যা কিছু থাকুক না কেন দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে অথবা হাই-টেক পার্কে অর্থ বিনিয়োগ করলে অর্থের উৎস নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে না।
এই বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প কলকারখানা স্থাপন করে সেবা অথবা পণ্য উৎপাদন করতে হবে। আর এ জন্য বিনিয়োগকারীকে মোট বিনিয়োগের শতকরা ১০ ভাগ কর প্রদান করতে হবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে না অর্থ হলো, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া।
প্রস্তাবিত অর্থ বিলে বলা হয়েছে, এ বছর পয়লা জুলাই থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই বিনিয়োগ করা যাবে। অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে।
দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ২০১০ সালে সারা দেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন পাশ করে আওয়ামী লীগ সরকার। একই বছর ডিজিটাল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে হাইটেক পার্ক আইন পাশ করা হয়। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।
বিরোধী দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “পাঁচ বছরের জন্য কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া একটি নজিরবিহীন ঘটনা। এর আগে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল এক বছরের জন্য।”
তিনি বলেন, “এ ধরনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপের মানুষ যারা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, পলিসি, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কথা মাথায় রেখে। বাংলাদেশে আর গণতন্ত্র নেই। এই দেশ কয়েকজন মুষ্টিমেয় লোক দ্বারা পরিচালিত। জনগণের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহি নেই।”
তিনি বলেন, “এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একজন দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক ২০০ কোটি টাকার একটি শিল্পে ২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ দেখাবে। এভাবে তারা তাদের অবৈধ টাকা সাদা করবে।”
বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া নতুন কিছু নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত এক বছর করে ১৯ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “তবে, এবারই প্রথম পাঁচ বছরের জন্য কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলো। পাঁচ বছরের জন্য কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া নজিরবিহীন।”
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাজেটে এ ধরনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’ নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। এবং অনৈতিক ও সংবিধান বিরোধী।”
তিনি বলেন, “এ ধরনের ঘোষণার মাধ্যমে সমাজে কী ধরনের বার্তা যাবে! এর মাধ্যমে সমাজে দুর্নীতিকে লেলিয়ে দেয়া হবে।”
টিআইবি নির্বাহী প্রধানের মতে, “কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া অনৈতিক ও সংবিধান বিরোধী। এর মাধ্যমে যারা দুর্নীতি করেন না, সৎ পথে আয় করেন তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়।”
তিনি বলেন, “সুতরাং, আমরা আশা করি জাতীয় সংসদ বিষয়টি বিবেচনা করে এ ধরনের প্রস্তাব বাদ দেবেন।”
অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বেনারকে বলেন, “সরকার হয়তো অঘোষিত অর্থকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য এমন প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু এর ফলাফল হবে উল্টো। এর মাধ্যমে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে মনে হতে পারে।”
তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করা উচিত।
ফ্ল্যাটের সঙ্গে জমিও যুক্ত হয়েছে
ফ্ল্যাট ও জমি কেনার ক্ষেত্রে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। এখন থেকে ফ্ল্যাট ও জমি কিনে আয়তনের ওপর এলাকাভেদে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলে কোনো প্রশ্ন করবে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এত দিন ফ্ল্যাট কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও এবার নতুন করে জমি যুক্ত করা হলো।
প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল ও দিলকুশায় ২০০ বর্গমিটারের কম ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক ভবন কিনলে প্রতি বর্গমিটারে ৪ হাজার টাকা এবং ২০০ বর্গমিটারের বেশি ফ্ল্যাট ও ভবন কিনলে প্রতি বর্গমিটারে ৫ হাজার টাকা কর দিতে হবে। আর জমি কেনার ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১৫ হাজার টাকা দিতে হবে। প্রতি বর্গমিটার ৯ বর্গফুট আয়তনের সমান।
একইভাবে ধানমন্ডি, ডিওএইচএস, মহাখালী, লালমাটিয়া, উত্তরা, বসুন্ধরা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, কারওয়ান বাজার, বিজয়নগর, সেগুনবাগিচা, নিকুঞ্জ, চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, খুলশী, আগ্রাবাদ ও নাছিরাবাদ এলাকায় ফ্ল্যাট ও ভবন কেনায় ২০০ বর্গমিটারের কম হলে বর্গমিটারপ্রতি ৩ হাজার টাকা, ২০০ বর্গমিটারের বেশি হলে ৫ হাজার টাকা কর হবে। জমি কিনলে প্রতি বর্গমিটারে ১০ হাজার টাকা দিতে হবে।
অন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় আয়তন ও টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ লক্ষাধিক কোটি টাকার বাজেট
বৃহস্পতিবার আহম মুস্তাফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করেন। বাজেটের আকার পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। গত বছরের বাজেটেরে আকার ছিল চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শতকরা ৬২ দশমিক ২ ভাগ, অভ্যন্তরীণ ঋণ ১৪ দশমিক ৮ ভাগ, বৈদেশিক ঋণ শতকরা ১২ দশমিক ২ ভাগ, কর ব্যতীত প্রাপ্তি সাত দশমিক দুই ভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত কর দুই দশমিক আট ভাগ এবং বৈদেশিক অনুদান শূন্য দশমিক আট ভাগ অর্থের সংস্থান করবে।
বক্তৃতায় দেশের কর প্রদানকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী মুস্তাফা কামাল।
মন্ত্রী বলেন, “আমাদের দেশে চার কোটি নাগরিক মধ্যম আয়ের অন্তর্ভুক্ত। অথচ দেশে আয়কর প্রদানকারী নাগরিকের সংখ্যা ২১-২২ লাখ। এই সংখ্যা আমরা দ্রুততম সময়ের মাঝে এক কোটিতে যাব। আর বাকি নাগরিকদেরও চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে কর জাল এর আওতায় নিয়ে আসার কার্যক্রম অব্যাহত রাখব।”
অর্থমন্ত্রী বিএনপি আমলের সাথে তুলনা করে বলেন, ২০০৫-০৬ সালে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে তা ৩০২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পৌঁছেছে।
মাথাপিছু আয় ২০০৫-০৬ সালে ছিল ৫৪৩ ডলার। বর্তমানে ১,৯০৯ ডলার।
২০০৫-৬ অর্থবছরে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে।
প্রবাসী আয় ৪.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১৮ সালের শেষের দিকে ১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
২০০৫-৬ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩.৫ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
বাজেট বক্তৃতার মাঝখানে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাজেটের শেষাংশ পাঠ করেন। অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতার কারণে শুক্রবার বিকেলে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী।