পাচার ঠেকাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ: প্রধানমন্ত্রী

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.06.14
ঢাকা
190614_PM_Budget-Bangla_1000.jpg ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২০১৯-২০ অর্থ বছরের বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথা অনুসারে বাজেট উপস্থাপনের পরদিন অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও মন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামালের অসুস্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংবাদ সম্মেলন করেন। ১৪ জুন ২০১৯।
[ফোকাস বাংলা]

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের মধ্যে থাকা কালো টাকা অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনতেই বাজেটে সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে; অন্যথায় টাকাগুলো দেশের বাইরে চলে যেত।

শুক্রবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপীদের’ বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে তাঁর সরকার।

বাজেটে ধনীরা উপকৃত হবে—গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এমন সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে ২০১৯-২০ সালের প্রস্তাবিত বাজেটকে জনকল্যাণের বাজেট বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

প্রথা অনুসারে বাজেট উপস্থাপনের পরদিন অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও মন্ত্রী আহম মুস্তাফা কামালের অসুস্থতার কারণে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংবাদ সম্মেলন করেন।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, “কালো টাকা আমাদের অর্থনীতির মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় এগুলো দেশের বাইরে পাচার হয়ে যাবে। এটি বন্ধ করতেই বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়েছি। আমাদের সরকারসহ সব সরকারই এ ধরনের সুবিধা দিয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা চাই না কালো টাকা দেশের ভেতর জমে স্তুপ হয়ে থাক বা বাইরে চলে যাক।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে এবং দেশের হাই-টেক পার্কে কালো টাকা বিনিয়োগ করার জন্য এ সুযোগ দেয়া হয়েছে।

“কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে শতকরা ১০ ভাগ কর দিতে হবে,” যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।

২০১৯-২০ সালের প্রস্তাবিত অর্থ বিলে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে অথবা হাই-টেক পার্কে কালো টাকা বিনিয়োগ করলে অর্থের উৎস নিয়ে কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করবে না সরকার।

প্রস্তাবিত অর্থ বিল অনুসারে, এ বছর পয়লা জুলাই থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই বিনিয়োগ করা যাবে। অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের পুরো সময়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে।

এছাড়া, প্লট এবং জমি কিনলেও কালো টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। তবে প্রতি বর্গমিটারে এ জন্য নির্দিষ্ট কর দিতে হবে।

দেশে এ পর্যন্ত ২০ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হলেও “কালো টাকার সামান্যই বিনিয়োগে এসেছে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “এ ধরনের সুযোগ কালো টাকার মালিকদের উৎসাহিত করে। আসলে উনাদের রাজনীতি হচ্ছে কালো টাকাকে কেন্দ্র করে। তাদের মালিকদের কেন্দ্র করে। তাই এধরনের কথা বলা হয়।”

দেশে কী পরিমাণ কালো টাকা আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

তবে গত বছর আগস্টে মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান সাংবাদিকদের বলেন, দেশের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৪০০ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছে। তিনি বিস্তারিত কিছু জানাননি।

তবে এ বছর জানুয়ারি মাসে প্রকাশ করা এক হিসাবে ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বলেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশের বাইরে চলে গেছে। ২০১৪ সালে এই পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার

দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যাংকের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হবে।”

তিনি বলেন, দেশে ব্যাংক খাতে সুদের হার অত্যন্ত বেশি, আর সুদ ধরা হয় চক্রবৃদ্ধি হারে।

শেখ হাসিনা বলেন, “ফলে যখন হিসাব প্রকাশ করা হয় তখন চক্রবৃদ্ধি হারে খেলাপি ঋণের পরিমাণটা অনেক বড় দেখায়। প্রকৃত ঋণটা যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে অত বড় না।”

খেলাপিদের ঋণ পরিশোধের ‘একটা সুযোগ’ দেওয়া হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

“কোনো ব্যাংকই সরল সুদে ঋণ দেয় না,” বলে মন্তব্য করে খেলাপি ঋণ সম্পর্কে প্রধামন্ত্রীর ব্যাখ্যার সাথে দ্বিমত করেন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম।

অধ্যাপক মইনুল বলেন, “ব্যাংক থেকে ঋণ যারা নেন তাঁদেরকে চক্রবৃদ্ধি হারেই সুদ দিতে হয়। চক্রবৃদ্ধি সুদ ধরেই খেলাপি ঋণ হিসাব করা হয়। এটাই ব্যাংকের নিয়ম।”

“উনি খেলাপিদের ঋণের পরিমাণ সরল সুদে হিসাব করবেন। আর যারা নিয়মিত ঋণ গ্রহীতা তারা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ দেবেন। এটা কোনো বিচার হলো না,” বলেন অধ্যাপক মইনুল

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকায়।

এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত সেই পরিমাণ এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

অর্থাৎ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৩ জুন সংসদে পেশ করা বাজেটের প্রায় এক পঞ্চমাংশ অর্থের সমান।

বাজেটে ধনীদের প্রাধান্য

শুক্রবার বাজেট নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ সম্মনিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া​র পদক্ষেপ সঠিক নয়।

তিনি বলেন, “যে আয় করে খায় তাদের বাজটে​ কোনো সুবিধা দেওয়া হয়নি। সুবিধা দেওয়া হয়েছে বিত্তবানদের।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটে ধনীদের বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এটা অপশাসনের সুবিধাভোগীদের পক্ষে গেছে।

তিনি বলেন, বাজেটে প্রান্তিক মানুষের জন্য রয়েছে প্রান্তিক সুবিধা। তবে মধ্যবিত্তের খুব বেশি সুবিধা হবে না।

তাঁর মতে, “অঘোষিত আয় এবং বেআইনি আয়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করতে হবে।”

তিনি বলেন, “বাজেটে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরা হয়নি এবং সমাধানের কোনও আভাস নেই। ব্যাংক খাতের সমস্যা নিয়ে বাজেটে আলোচনা আছে, কিন্তু কর্মপরিকল্পনা নেই। ব্যাংকিং খাতের সমস্যাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।”

ড. দেবপ্রিয় বলেন, সরকারি টাকায় অবকাঠামো নির্মাণ করে জিডিপি বাড়ানোর চেষ্টা প্রাগৈতিহাসিক ধারণা। এটা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি করছে।

এদিকে বিরোধী দল বিএনপি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে শুক্রবার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করা হয়নি। একটি গোষ্ঠী ও ধনীদের কথা মাথায় রেখে এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।