বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা মামলায় ২০ ছাত্রের মৃত্যুদণ্ড

আহম্মদ ফয়েজ
2021.12.08
ঢাকা
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা  মামলায় ২০ ছাত্রের মৃত্যুদণ্ড বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর আসামিদের একে একে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। ৮ ডিসেম্বর ২০২১।
সাবরিনা ইয়াসমীন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বুধবার ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। আর পাঁচ জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ।

বাংলাদেশ ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক ও ফেনী নদীর পানি সংক্রান্ত একটি চুক্তির সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার জের ধরে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। আসামিদের সবাই সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বিচার নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়।

সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই নির্মম খুনের ঘটনায় আবরারের বাবা চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন, বেনারকে জানান ওই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো: আবু আবদুল্লাহ্ ভূঁঞা।

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান আসামিদের উপস্থিতিতে আবরার হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। এসময় তিনি যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত আসামিদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর কারাদণ্ড ঘোষণা করেন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২০ আসামি হলেন; বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. অনিক সরকার ওরফে অপু, সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, উপ-সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, ক্রীড়া সম্পাদক মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, ছাত্রলীগকর্মী মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মো. মুজাহিদুর রহমান, মো. মনিরুজ্জামান মনির, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, এস এম মাহমুদ সেতু, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল ওরফে জিসান, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও মুজতবা রাফিদ।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন; বুয়েট ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহতামিম ফুয়াদ, গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, আইন বিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা, ছাত্রলীগকর্মী আকাশ হোসেন এবং মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা।

২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ওয়াহিদুজ্জামান ২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এরপর ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মামলার বিচারকাজ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর জন্য ঢাকার মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) কার্যালয়ে আবেদন করেন মো. বরকত উল্লাহ। পরে ১২ মার্চ আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক আবরার হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর ফাইল অনুমোদন করেন।

এই মামলার রায় ঘোষণাকালে আদালতে বিচারক বলেন, “নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় দেওয়া হয়েছে। শিবির সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা পুরো জাতিকে স্তব্ধ করেছে।”

রায়ের সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ।

রায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এ রায়ে আমরা খুশি। তবে এ রায় উচ্চ আদালতে বহাল থাকলে আরো বেশি খুশি হবো। আমি চাই রায়টি দ্রুত কার্যকর হোক এবং পলাতক বাকি তিন আসামিকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে সাজা কার্যকর করা হোক।”

এই রায়টি সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গুলশানের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে যে, এ মামলায় প্রকৃত ন্যায়বিচার করা হয়েছে। এই রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পেরেছে যে, দেশে আইনের শাসন আছে। এখন কেউ এরকম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে না।”

“এই রায়ের নথিপত্র আগামী সাতদিনের মধ্যে হাইকোর্টে চলে যাবে। সেখানে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার ব্যাপারে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে,” যোগ করেন আইনমন্ত্রী।

আসামিদের স্বজনেরা দেখিয়েছেন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া

আলোচিত আবরার হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের স্বজনেরা দেখিয়েছেন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলামের বাবা রবিউল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “আমি আমার ছেলেকে খুঁজে পুলিশে দিয়েছি। নিজে তাকে আত্মসমর্পণ করিয়েছি। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে এই রায় আশা করিনি। গণহারে ফাঁসি ও যাবজ্জীবন দেওয়া হলো। এতে আমরা হতবাক। এমন রায়ের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।”

“ঘটনার আকস্মিকতায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। কেউ পেশাদার অপরাধী না। সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী। আমরা উচ্চ আদালতে যাব,” যোগ করেন রবিউল।

অমিত সাহার মা দেবী রানী বলেন, “গণমাধ্যমের চাপে অমিতকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাকে জড়ানো হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, সে নাকি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে কথা বলেছে। এ জন্য যাবজ্জীবন সাজা! আমাদের প্রত্যাশা ছিলো অমিত খালাস পাবে।”

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা খুশি

আবাবার হত্যার এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা।

বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান তারা।

আদালতের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা বলেন, বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে নির্মম নির্যাতনে নিহত বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ে সবার আস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। এখন ওই রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাচ্ছি।

শিক্ষার্থীরা আবরারের পরিবারের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে এ রায় যেন উচ্চ আদালতে শেষ পর্যন্ত বহাল থাকে, সেই দাবি জানান।

তারা আরও বলেন, সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মুজতবা রাফিদ ও মোর্শেদ-উজ-জামান মন্ডল জিসান এখনো পলাতক। তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় এনে রায় কার্যকর করতে হবে।

বুয়েট ভিসির সহায়তার আশ্বাস

আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে এবং দ্রুত সাজা বাস্তবায়ন চেয়ে বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রাসাদ মজুমদার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আবরার হত্যা মামলা চালাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত বুয়েটের ৫৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

রায় ঘোষণার পর বুয়েটে ভিসির কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।

“আবরারের পরিবারের পক্ষ থেকে যেটুকু চাওয়া হয়েছে তা আমরা দিয়েছি। মাসিক সাহায্য করেছি। প্রতি মাসে ৭৫ হাজার টাকা দিচ্ছি। ওনারা আর্থিকভাবে সংকটে পড়েছেন। এজন্য আমি উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার পর জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে প্রতি মাসে ৭৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে,” বলেন প্রসাদ মজুমদার।

তিনি আরো বলেন, এ ছাড়া আইনি সহায়তা ও আইনজ্ঞের ফি এবং সাক্ষী হিসেবে শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার খরচসহ মামলার আনুষঙ্গিক সব খরচ বুয়েট বহন করছে।

“এর বাইরে প্রতি মাসে যেটা দেওয়া হচ্ছে সেটা ১২ বছর দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে উনি যদি আমাদের কাছে চান এই সাপোর্ট আমরা অবশ্যই দেব,” বলেন বুয়েট ভিসি।

গণহারে মৃত্যুদণ্ড উদ্বেগজনক

আববার হত্যা মামলায় দেওয়া রায়সহ সাম্প্রতিক আলোচিত বেশ কিছু মামলায় বিচারিক আদালতে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা কিছুটা বেশি ঘটছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান।

মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকা উচিত কি উচিত না সেই আলোচনায় না গেলেও দেখা যাবে-বাংলাদেশের নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ঘটনা প্রচুর ঘটছে। তবে তা উচ্চ আদালতে গিয়ে বহাল থাকছে না। এতে করে মনে হতে পারে, মানুষকে খুশি করার জন্যই এসব রায় হচ্ছে,” বলেন মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কাজ করা এই গবেষক।

তিনি বলেন, “উচ্চ আদালতে এই রায় বহাল না থাকলেও দেখা যাবে এই আসামিদের ব্যাপক ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। নিম্ন আদালতের অধিকাংশ রায়ই ওপরের আদালতে অপরিবর্তিত থাকা উচিত, কিন্ত‍ু আমাদের এখানে সেটা হচ্ছে উল্টো।” 

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।