বেসরকারি পরিবহন খাতে বছরে চাঁদাবাজি হাজার কোটি টাকা: টিআইবির গবেষণা

আহম্মদ ফয়েজ
2024.03.05
ঢাকা
বেসরকারি পরিবহন খাতে বছরে চাঁদাবাজি হাজার কোটি টাকা: টিআইবির গবেষণা ঢাকার গুলিস্তান এলাকার প্রধান সড়কে যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে ফিটনেসবিহীন একটি বাসটি। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
[মেহেদী রানা/বেনারনিউজ]

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের বেসরকারি খাতের বাস মালিক ও শ্রমিকরা বছরে প্রায় এক হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হন।

“ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে মঙ্গলবার ঢাকায় নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি এই তথ্য প্রকাশ করে। 

এর মধ্যে সড়কে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দলীয় পরিচয়ে চাঁদাবাজি হয় বলে গবেষণায় উঠে এসেছে জানিয়ে বলা হয়, “এছাড়া রাজনৈতিক সমাবেশ, বিভিন্ন দিবস পালন, টার্মিনালের বাইরে (রাস্তায়) পার্কিং এবং সড়কের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও টোকেন বাণিজ্যের জন্য বাস মালিক ও কর্মী-শ্রমিকরা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেয় বা দিতে বাধ্য হয়।”

এই হাজার কোটি টাকা চাঁদার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো অংশ বছরে ৯০০ কোটি টাকা নিবন্ধন ও সনদ গ্রহণ, হালনাগাদের জন্য ঘুষ হিসেবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) দিতে হয় বাস মালিক-শ্রমিকদের, বলা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।

গবেষণার বরাত দিয়ে টিআইবি জানায়, বাংলাদেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস পরিবহন খাত আপাদমস্তক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।

টিআইবির এই গবেষণা প্রতিবেদনকে স্বাগত জানিয়েছেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক।

“গবেষণাটি পরিবহন খাতের সুশাসন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে। সরকারের উচিত প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা,” বলেন তিনি।

টিআইবির সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও সিন্ডিকেট এই খাতকে জিম্মি করে রেখেছে, ক্ষেত্র বিশেষে এই আঁতাতের সামনে সরকারও ক্ষমতাহীন হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।

বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মূলে থাকা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সিন্ডিকেটের ভূমিকা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস পরিবহন খাত আপাদমস্তক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় বলিয়ান মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের আঁতাত।

গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের মালিক ও পরিচালনা পর্ষদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে, ৮০ শতাংশ ক্ষমতাসীন দল ও বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য দলের।”

তিনি বলেন, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার ফলে এই জনগুরুত্বপূর্ণ খাতটি যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন হয়ে উঠবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে তা জিম্মি হয়ে গেছে এসব মালিক শ্রমিকদের সংগঠনের কাছে। আর এই জিম্মিদশার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে সিন্ডিকেট।  এই জিম্মি দশা এতটাই প্রকট যে মালিক-শ্রমিকের আঁতাতের কারণে তাদের আচরণ অবস্থাদৃষ্টে সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হিসেবে মনে হয়।

ব্যক্তি মালিকানাধীন বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে সরকার তার নিজের প্রণীত আইন ও নিয়ম-নীতি বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না দাবি করে তিনি বলেন, প্রত্যাশিত সেবাও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না, একইসঙ্গে এ খাতের সাধারণ শ্রমিকরাও তাদের মৌলিক অধিকারসহ ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বাস পরিবহন ব্যবসায় বিভিন্ন আঙ্গিকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ লেনদেনের ঘটনা ঘটে। এসব ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন, হাইওয়ে পুলিশ, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের যোগসাজশ রয়েছে।”

বিআরটিএ তার নির্ধারিত ভূমিকা পালন করতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যাত্রী সেবার ব্যর্থতা ঢাকতে লোকবল সংকটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বিআরটিএ। অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেনের সবই চলছে যোগসাজশের মাধ্যমে।  অবস্থা প্রকটতর হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে, এই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভের অংশীদার কম-বেশি সংশ্লিষ্ট সকলে।  এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে আহ্বান জানাই আমরা। কারণ, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তা আরও বিকশিত হয়।”

ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে বাস পরিবহন খাত

টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থনপুষ্টদের দ্বারা পরিবহন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ।

জরিপে অংশগ্রহণকারী ২২টি (১৩ দশমিক এক শতাংশ) কোম্পানির কাছে ৮১ দশমিক চার শতাংশ বাসের মালিকানা রয়েছে এবং এসব বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল (৮০ শতাংশ) এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের (১২ শতাংশ) প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।  তারা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনে একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার পাশাপাশি নীতি করায়ত্ত করার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে খাতটিকে জিম্মি করে রেখেছেন।

বাস পরিবহনে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রকট উদাহরণ দিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জরিপে অংশগ্রহণকারী কর্মী-শ্রমিকদের ৪০ দশমিক নয় শতাংশের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে।

২৪ শতাংশ কর্মী-শ্রমিকের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কোনো না কোনো বাসের ফিটনেস সনদ নেই এবং ২২ শতাংশ বলেছেন, বাসের রুট পারমিট নেই।

“চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে, তবে সব তথ্য সত্য নয়”

টিআইবির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান বেনারকে বলেন, “বকশিশসহ নানা নামে চাঁদাবাজি হয় এটা সত্য।  এই চর্চা আমাদের এখানে অনেক দিন ধরে হয়ে আসছে।  তবে টিআইবির সব তথ্য সত্য নয়।”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর কমিটির নেতা এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বেনারকে বলেন, “বিভিন্ন সংস্থাকে চাঁদা দিতে হয় এটা সত্য। তবে টিআইবির সব তথ্য সঠিক নয়।”

টিআইবির কোন কোন তথ্য সঠিক না জানতে চাইলে পরিবহন খাতের এই দুই নেতার কেউই মন্তব্য করতে চাননি।

টিআইবির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বেনারকে বলেন, “টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন আমাদের নজরে এসেছে। আগামীকাল (বুধবার) সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের বক্তব্য দেওয়া হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।