অর্ধযুগ পর শেয়ার বাজারে আবার ঊর্ধ্বগতি, আছে আশা ও আশঙ্কা
2017.02.08

মহা পতনের অর্ধযুগ পর আবার নতুন উচ্ছ্বাস আর শঙ্কার দোলাচলে বাংলাদেশের শেয়ার বাজার। গত ডিসেম্বরে বাজারে ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। দুই মাসের ব্যবধানে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এ ঘটনার পর আবারও বাজারের দিকে ছুটতে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ। তাঁদের এই উচ্ছ্বাসের সঙ্গে শঙ্কাও বাড়ছে। মাঝেমধ্যে টানা পড়ে যাচ্ছে সূচক, কমছে লেনদেন।
ছয় বছর আগে (২০১০ সালে) বাজারের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে দৌড়াতে শুরু করেছিল দেশের লাখ লাখ মানুষ। এরপর ঘটে বাজারের আকস্মিক পতন। সেই পতন এমন তলানিতে পৌঁছে যে অসংখ্য মধ্যবিত্তের সকল পুঁজি নিঃশেষ হয়ে যায়। এর আগে ১৯৯৬ সালেও শেয়ার বাজারে সর্বস্ব খুইয়েছিলেন লাখ লাখ মানুষ।
কোনো অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াই সে সময় বাজার উঠেছিল এবং কোনো অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াই বাজার তলানিতে পৌঁছে যায়। এর সবটাই ছিল প্রতারণামূলক। সরকারের তদন্তেই এ কথা বেরিয়ে এসেছে। যদিও ওই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি
এবার বড় রকমের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তৈরি হয়েছে হঠাৎ করেই। দুই মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সূচক ৪ হাজার ৭০০-এর কাছাকাছি থেকে ৯০০ পয়েন্টের মতো বেড়ে ৫ হাজার ৫৭৫-এ ওঠে। জানুয়ারির ১ তারিখ ঢাকার শেয়ার বাজারে লেনদেন ৯০০ কোটি টাকার ঘরে অবস্থান করেছে। পরের দিন এই লেনদেন ১৪০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। এর আগে পুরো সপ্তাহ জুড়ে ছিল রেকর্ড পরিমাণ লেনদেন।
জানুয়ারির ১১ তারিখ দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়। বাজারে লেনদেন এবং সূচক প্রায় প্রতিদিনই বাড়তে থাকে এবং নতুন নতুন বিনিয়োগকারীর সমাগম শুরু হয়। আকস্মিক উত্থানে কারসাজি আছে কি না মানুষের মধ্যে সেই সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
সাদ সিকিউরিটিজ এর সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করেন ত্রিদিব সাহা। বেনারকে ত্রিদিব বললেন, “২০১০ সালের পর বারবার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও তা স্থায়ী হয়নি। বরং এই ইঙ্গিতে যখনই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আশায় বুক বাঁধেন, তখনই কারসাজির হোতারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাজার যখনই কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয় ঠিক তখনই কারসাজি চক্র শেয়ার বিক্রি শুরু করে, ফলে শুরু হয় দরপতন।”
উল্লেখ্য, সাধারণ মূল্য সূচক, পয়েন্ট ও লেনদেনের মাধ্যমে শেয়ার বাজারের চিত্র প্রতিফলিত হয়। বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম যখন বাড়ে তখন সূচক ও পয়েন্ট বাড়ে। আবার বেশিরভাগ কোম্পানির দাম কমলে সূচক ও পয়েন্ট কমে।
আবার বড় দরপতন
হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি দৃশ্যমান হলে সতর্ক করা হয় চারদিক থেকে। গত ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর ফজলে কবির শক্ত ভাষায় শেয়ারবাজার বিষয়ে সতর্কবার্তা দেন। এর তাৎক্ষণিক প্রভাবে ওই দিনই বাজারে বড় দরপতন ঘটে।
গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে (বৃহস্পতিবার, ফেব্রুয়ারি ২) শেয়ারবাজারে আবারও বড় ধরনের দরপতন ঘটে। ওই দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১০৯ পয়েন্ট বা প্রায় ২ শতাংশ কমে যায়। চট্টগ্রামে আরও বেশি। সিএসই সার্বিক মূল্য সূচক ওই দিন ৩৪৩ পয়েন্ট কমে। টানা প্রায় ১০ দিন নিম্নগামী থাকার পর মঙ্গলবার থেকে বাজার আবারও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। বুধবার ডিএসই ও সিএসই’র সব সূচক বেড়েছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি
বাজারের উল্লম্ফন ঠেকাতে ব্যাংক খাতে তদারকি বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ-সংক্রান্ত তথ্য প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
বাজারের মূল নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনও সতর্কতামূলক ঘোষণা দেয়। স্পনসরদের শেয়ার এবং উচ্চ প্রাইস আর্নিংস রেশিওধারী শেয়ারগুলোর বিপরীতে মার্জিন ঋণ জোগানোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজন হতে পারে বলে জানান তিনি।
পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ
বাজার ওপরে ওঠার কয়েক মাস আগে থেকেই বিনিয়োগ বাড়াতে শুরু করেছিল বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি ও বিনিয়োগকারী। তারা বাজারে শেয়ার বিক্রির চেয়ে বেশি পরিমাণে কিনেছে। ২০১৬ সালে বিদেশিরা ৮ হাজার ৭৭৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করে। সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা ৫ মাস বিদেশিরা বাজার থেকে যে পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন বিক্রি করেছেন তার চেয়ে কম।
এ ব্যাপারে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, “অর্থনৈতিক উন্নতির তুলনায় দীর্ঘদিন থেকে শেয়ারের দাম বেশ কম। এই অবস্থায় শেয়ার কিনলে লাভবান হবে এই বিবেচনায় বাজারে এসেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। এটা ভালো লক্ষণ। তারা এক সময় মুনাফা তুলে নেবে। সে সময় ভিত সন্ত্রস্ত না হয়ে সময় থাকতেই সতর্ক হতে হবে বিনিয়োগকারীদের।”
জরিপ প্রতিবেদনে আশাবাদ
সবকিছুর পরও আশাবাদ দেখছেন বাজার বিশ্লেষক ও বিনিয়োগকারীরা। চলতি বছর পুঁজিবাজারে চাঙাভাব অব্যাহত থাকবে বলে একটি সাম্প্রতিক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যাংক ঋণের সুদের হার কম থাকায় শেয়ার বাজারে ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকবে বলে মনে করছেন জরিপে অংশ নেওয়া বিনিয়োগকারী ও বাজার বিশ্লেষকেরা।
গত রোববার (৩১ জানুয়ারি) প্রকাশিত লঙ্কা-বাংলা ফাইন্যান্স এর ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী বাজার সংশ্লিষ্ট ৮৭ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, “২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে পুঁজিবাজারের অবস্থা ভালো থাকবে।”
ডিএসই’র পরিচালক রকিবুর রহমান বেনারকে বলেছেন, “বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে গত কয়েক বছরে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের দিক থেকেও ইতিবাচক নানা বার্তা দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিফলন বাজারে দেখা যাচ্ছে।”
তার মতে, “বিনিয়োগকারীদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে রেমিটেন্সের টাকা, গয়না বিক্রির টাকা, ধার করে বা জমি বিক্রি করে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে এটি শতভাগ ঝুঁকির জায়গা।”
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম বেনারকে বলেছেন, “পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার জন্য ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার আসা দরকার। নির্ভরযোগ্য কোম্পানির শেয়ার আসলে বিনিয়োগকারীরা সেগুলো কিনবে। ফলে খারাপ শেয়ারের দাম বাড়বে না।”