বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় নিউমোনিয়ায় মারা যায় দুইটি শিশু
2019.05.29
ঢাকা

আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন বলছে, বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় দুটি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। গত দুই দশকে শিশু মৃত্যুর হার ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনলেও নিউমোনিয়া রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংস্থাটি তৃতীয়বারের মতো প্রকাশ করেছে বার্ষিক ‘গ্লোবাল চাইল্ডহুড রিপোর্ট–২০১৯’। এই প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া এখনো মৃত্যুর প্রধান কারণ। অন্যান্য রোগের বেশির ভাগই এখন নিয়ন্ত্রণে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের এ দেশীয় উপপরিচালক ইশতিয়াক মান্নান বলেন, শিশুর জীবন বিকাশে বাংলাদেশের বিশাল অগ্রগতিকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। ২০ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া শিশুদের স্বাস্থ্যবান, সুখী, শিক্ষিত এবং সুরক্ষিতভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে নিউমোনিয়া একটা বাধা।
“নিউমোনিয়া মোকাবিলা করা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকে যাচ্ছে, বিশেষ করে দূরবর্তী গ্রামগুলোতে এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা শিশুদের মধ্যে,” ইশতিয়াক মান্নান বলেন।
১ জুন আন্তর্জাতিক শিশু দিবসকে সামনে রেখে শিশু স্বাস্থ্যের এই সামগ্রিক পরিস্থিতি প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল গত দুই দশকে শিশু মৃত্যুর হার অনেকটা কমিয়ে এনেছে।
চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিশু মৃত্যুর হার ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। অন্যদিকে ভুটানে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৬০ শতাংশ, নেপালে ৫৯ শতাংশ এবং ভারতে ৫৭ শতাংশ।
এই অগ্রগতির পরও ২০১৮ সালের ‘ন্যাশনাল সিচুয়েশন অ্যানালাইসিস রিপোর্ট অফ নিউমোনিয়া’ (বাংলাদেশ সরকার সমর্থিত সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন) প্রতিবেদনের তথ্য হলো, জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পাঁচ বছরের নিচে মোট ১৬ শতাংশ শিশুর এবং ১২-৫৯ মাস বয়সী শিশুর মধ্যে মোট ৩০ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর জন্য নিউমোনিয়া দায়ী।
তা ছাড়া, দেখা যায় নিম্ন আয়ের দেশগুলোতেও নিউমোনিয়ায় পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুও হার বেশি। এর মধ্যে আবার ধনী পরিবারের শিশুদের তুলনায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মৃত্যুহার দ্বিগুণ।
যে কারণে নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না
সেভ দ্য চিলড্রেনের কর্মকর্তা তাসকিন রহমান বলছিলেন, মূলত অজ্ঞতা ও ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে। তিনি বলছিলেন, সাধারণ কফ-কাশি, জ্বরই হচ্ছে নিউমোনিয়োর লক্ষণ। অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা লক্ষণ দেখেই রোগটি শনাক্ত করতে পারেন।
“খুব সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকেই প্রাথমিক অবস্থায় নিউমোনিয়া সেরে যায়। অনেক সময় রোগটি শনাক্ত হচ্ছে না বা হলেও এত দেরিতে হচ্ছে কিংবা এত দেরিতে আক্রান্ত শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে যে, তখন আর পরিস্থিতি চিকিৎসকের নিয়ন্ত্রণে থাকে না,” তাসকিন রহমান বেনারনিউজকে বলেন।
প্রধানত দুর্গম এলাকায়, যেখানে হাতের নাগালে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র নেই সেই এলাকাগুলোয় শিশুরা বেশি ভুগছে। চর, হাওরাঞ্চল বা পাহাড়ি এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা সহজে মেলে না। এ অঞ্চলগুলো বিশেষ যত্নের দাবি রাখে বলে উল্লেখ করেন তাসকিন।
সেভ দ্য চিলড্রেন জানায়, সরকারের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচির মধ্যে নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন অন্তর্ভুক্ত করেছে সেভ দ্য চিলড্রেন এবং তার সহযোগী সংস্থাগুলো। এই জাতীয় নিউমোনিয়ায় সাধারণত দুই বছরের কম বয়সী শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম অবশ্য দাবি করেছেন, আগের চেয়ে নিউমোনিয়ায় শিশু মৃত্যুও হার কিছুটা কমেছে। তবে কাঙ্খিত মাত্রায় নয়। এর জন্য বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন তিনি।
“দেখুন বাংলাদেশে এখনো কম ওজনের শিশু জন্মাচ্ছে। এই শিশুদের ফুসফুস খুব সহজে আক্রান্ত হয়। দূষণটাও এখানে মারাত্মক। ফলে শিশুরা নিউমোনিয়ায় ভোগে বেশি,” জাহাঙ্গীর আলম বেনারনিউজকে বলেন।
তিনি আরও বলেন, নিউমোনিয়ার ব্যবস্থাপনা খুব জটিল নয়। এখন গ্রামাঞ্চলে কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সেখানে দক্ষ জনস্বাস্থ্যকর্মী রয়েছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ অজ্ঞতার কারণে আসছে না। শিশুরা ভুগছে। মারা যাচ্ছে।
কিন্তু দুর্গম অঞ্চলের মানুষ বলছেন, সরকারি স্বাস্থ্যসেবার গলদের বলি হচ্ছে শিশুরা। কথা হয় দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার গৃহবধূ জাহানারা বেগমের সঙ্গে। হাওরবেষ্টিত এই অঞ্চল বছরের একটি বড় সময়ে জলমগ্ন থাকে।
জাহানারা বলছিলেন, সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ বেশ কিছু উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা বলতে আসলে কিছু নেই।
“আমাদের এখানে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। চার দিন খোলা থাকার কথা, কিন্তু থাকে না। উপজেলা হাসপাতালে বেশির ভাগ সময় ডাক্তার থাকে না। সদর হাসপাতালে যেতে অ্যাম্বুলেন্স লাগে, হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স থাকলে চালক থাকে না,” বেনারকে বলেন জাহানারা। এ রকম এলাকায় শিশুরা আক্রান্ত হলে যাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না বলে জানান তিনি।
বিশ্ব শিশু স্বাস্থ্য পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো
প্রতিবেদনের এন্ড অফ চাইল্ডহুড ইনডেক্সে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ১৭৬টি দেশের মধ্যে ১৭৩টিতে শিশুদের অবস্থার সার্বিক উন্নতি ঘটেছে।
‘এণ্ড অফ চাইল্ডহুড রিপোর্ট’ পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, সংঘাত-সংঘর্ষের কারণে শিশুদের স্থানচ্যুতি বা জীবন বিপন্ন হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
‘গ্লোবাল চাইল্ডহুড রিপোর্ট–২০১৯’ এ চলতি বছর র্যাঙ্কিংয়ের প্রথমে রয়েছে সিঙ্গাপুর এবং শেষে রয়েছে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক। আর বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭।