বাংলাদেশ এখনো অধিক হারের শিশুমৃত্যুর দেশ
2017.06.28

পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার কমলেও এখনো উল্লেখযোগ্য শিশু মৃত্যুহারের দেশগুলোর তালিকা থেকে বের হতে পারেনি বাংলাদেশ। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার প্রকাশিত ‘ন্যারোয়িং দ্য গ্যাপস্: দ্য পাওয়ার অব ইনভেস্টিং ইন দি পুয়োরেস্ট চিলড্রেন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক এই সংস্থাটি। এতে বলা হয় ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার ৭৪ শতাংশ কমিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনো যেসব দেশে শিশু মৃত্যুহার বেশি বাংলাদেশ তার অন্যতম।
তবে সরকার মনে করছে, শিশু মৃত্যুহার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার মতো অসুখে শিশু মৃত্যুহার কমলেও জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মানো শিশুদের মৃত্যুহার এখনো কমানো সম্ভব হয়নি। যার জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রযুক্তিগত সাপোর্টের পাশাপাশি দক্ষ নার্সও প্রয়োজন।
এ বিষয়ে শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কানিজ হাসিনা শিউলি বেনারকে বলেন, “নিউমোনিয়া, ডায়রিয়ার মতো শিশুরোগগুলো আমরা নিয়ন্ত্রণ করেছি। তবে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে যেসব শিশু জন্মায়, তাদের মৃত্যুর হার এখনো ৪ শতাংশ।”
“এসব বাচ্চাদের জন্মের পরপরই নিয়মিত সার্জারি করি। এসব সার্জারির ক্ষেত্রে নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (এনআইসিইউ) থাকা খুব দরকার হয়। কিন্তু সরকারি হাসপাতালগুলোতে এই সাপোর্ট খুব কম। যা আছে রোগীর তুলনায় তা অত্যন্ত অপ্রতুল। ফলে সবাই পায় না,” বলেন তিনি।
এ ছাড়া দক্ষ নার্সও প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের এই চিকিৎসক।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নবজাতক শিশু ও কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম সরকার বেনারকে বলেন, “শিশু মৃত্যুহার রোধে অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে। আমরা সঠিক পথে আছি।”
“তবে এ সংক্রান্ত প্রোগ্রামগুলো এখনো একসঙ্গে সারা দেশে চালু করতে পারিনি। যেমন এখনো দেশের সব হাসপাতালে নবজাতক স্পেশাল কেয়ার ইউনিট চালু করা সম্ভব হয়নি। শিশু মৃত্যুহার কমাতে এমন অনেক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হলেও তৃণমূল পর্যায়ে এখনো সেগুলো ছড়িয়ে দিতে পারিনি। এগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে। খুব দ্রুত এর রেজাল্ট পাব,” বলেন তিনি।
ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলছে, ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রসবকালীন জটিলতা, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ার মতো শিশুমৃত্যুর কারণগুলো দূর করতে উচ্চ প্রভাব বিস্তারকারী সহজ প্রাপ্য এবং কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্য উদ্যোগের নীতি গ্রহণ করে। বিনা মূল্যে নিয়মিত সেবা দেওয়ার জন্য গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিকও স্থাপন করা হয়।
একই সময়ে নিরাপদ পানি, পয়ঃব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যবিধির ওপরও গুরুত্ব দেয় বাংলাদেশ। কমিউনিটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করে উন্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগের হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। যা ২০০৩ সালে ৪৩ শতাংশ ছিল, তা ২০১৫ সালে কমে ১ শতাংশে নেমে এসেছে।
এ ছাড়া ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে এক হাজার জীবিত জন্মে ১৪৪ শিশুর মৃত্যু হতো। ২০১৫ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮ জনে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মা ও নবজাতকের জীবন রক্ষার জন্য প্রসবকালীন সেবার মান বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
শিশুমৃত্যু কমানো আরও ত্বরান্বিত করা না হলে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই সারা বিশ্বে আরও ৭০ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যু হবে বলে আশঙ্কা করেছে ইউনিসেফ।
বাংলাদেশসহ ৫১টি দেশের তথ্য বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে সংস্থাটির নতুন এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। নবজাতক ও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর ৮০ শতাংশ ঘটনাই এই দেশগুলোতে ঘটে।
এই সব দেশে জীবন রক্ষাকারী উদ্যোগ দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে নেওয়া গেলে শিশুমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে ধনী শ্রেণির তুলনায় তিনগুণ দ্রুত ফল পাওয়া যায় বলে ইউনিসেফের বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে মাতৃ, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যের ওপর উচ্চ প্রভাব মূল্যায়নের জন্য ছয়টি স্বাস্থ্য উদ্যোগ বাছাই করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে; কীটনাশকে জারিত মশারি ব্যবহার, জন্মের পরপরই বুকের দুধ খাওয়ানোর হার, প্রসব পূর্ববর্তী সেবা, পূর্ণ টিকাদান, প্রসবকালে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর উপস্থিতি এবং ডায়রিয়া, জ্বর বা নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর সেবা।