পশ্চিমবঙ্গে শিশু পাচারে যুক্ত রাজনীতিক, চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তা

পরিতোষ পাল
2017.03.10
কলকাতা
শিশু পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার ‘বিমলা শিশু গৃহ’র কর্ণধার চন্দনা চক্রবর্তীকে সিআইডি অফিস থেকে জলপাইগুড়ি আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শিশু পাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার ‘বিমলা শিশু গৃহ’র কর্ণধার চন্দনা চক্রবর্তীকে সিআইডি অফিস থেকে জলপাইগুড়ি আদালতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ৪ মার্চ, ২০১৭, শিলিগুড়ি।
DIPTENDU DUTTA/AFP

দত্তকের নামে সেফ হোম থেকে শিশু পাচারের অভিযোগ এনেছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ। রাজ্যের নানা জায়গা থেকে পাচার চক্রের অনেককেই গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলছে, এর সঙ্গে রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, হোমের মালিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে।

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডি এসব ঘটনার তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন সিআইডির ডিজি রাজেশ কুমার।

গত ফেব্রুয়ারিতে দত্তক দেওয়ার নাম করে অবৈধ উপায়ে শিশু পাচারের অভিযোগে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বিমলা ‘শিশু গৃহ’ নামের একটি হোমের কর্ত্রী চন্দনা চক্রবর্তী, তাঁর ভাই মানস ভৌমিক ও হোমের অ্যাডপশন অফিসার সোনালি মন্ডলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

অভিযুক্ত সাবেক প্রধান শিক্ষিকা চন্দনার স্বীকারোক্তির পর গ্রেপ্তার হন ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির মহিলা মোর্চার পশ্চিমবঙ্গ শাখার সম্পাদিকা জুহি চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে নাম জড়িয়েছে আরও বেশ কয়েকজন বিজেপির শীর্ষ নেতার। পুলিশের অভিযোগ, চন্দনা চক্রবর্তীর হোমটি নির্বিঘ্নে চলার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য দিল্লিতে প্রভাবশালী মহলে তদবির করেছিলেন তিনি।

শিশু পাচারের কাজে সহযোগিতা করার অভিযোগে দার্জিলিং জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক মৃণাল ঘোষ, জলপাইগুড়ি জেলার শিশু সুরক্ষা আধিকারিক সুস্মিতা ঘোষ ও শিশু কল্যাণ কমিটির সদস্য চিকিৎসক দেবাশিস চন্দকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তরবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিআইডির এসপি অজয় প্রসাদ।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা অনেক সন্দেহভাজনকে জেরা করছি। নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনে আরও বেশ কয়েকজন চিকিৎসক, সরকারি আধিকারিক ও রাজনৈতিক নেতাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।”

উত্তরবঙ্গের ঘটনার তদন্তের মাঝেই কলকাতা সংলগ্ন দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতা থেকে একটি শিশু পাচার চক্রের হদিস পাওয়া গেছে। তিনটি সদ্যোজাত শিশুকে উদ্ধারের পাশাপাশি এক নার্সিং হোমের মালিকসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গত নভেম্বরে উত্তর ২৪ পরগণার বাদুড়িয়ার এক ডেরা থেকে ৩২টি সদ্যোজাত ও দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ। এই চক্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন জায়গা থেকে চিকিৎসক, নার্সিং হোমের মালিক ও এনজিও’র আধিকারিকসহ ১৮জনকে আটক করা হয়। এ সময় অনেক দেশের মুদ্রাও পায় পুলিশ।

দত্তকের নামে নিলাম করে শিশু বিক্রি

উত্তরবঙ্গের অভিযুক্ত হোমটি থেকে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে কমপক্ষে ১৭টি শিশুকে অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন ও সিঙ্গাপুরের বিদেশি দম্পতিদের কাছে দত্তক দেওয়ার নামে বিক্রি করা হয়েছে। এদের ইতিমধ্যেই বিদেশে পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সিআইডির এডিজি রাজেশ কুমার।

তদন্তকারীদের মতে, রীতিমতো নিলাম করে শিশু বিক্রি করা হতো। যে সব শিশুকে বিদেশি দম্পতিদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে তাদের বয়স ৬ মাস থেকে শুরু করে ১৪ বছর। আর এদের জন্য মূল্য হাঁকা হয়েছিল ১২ হাজার থেকে ২৩ হাজার মার্কিন ডলার।

ভারতে প্রায় ২ কোটি অনাথ শিশু রয়েছে। তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্য সমীক্ষা ও জনগণনা থেকে প্রাপ্ত তথ্য উল্লেখ করে এসওএস চিলড্রেন্স ভিলেজেস ইন্ডিয়া জানিয়েছে, এদের অধিকাংশই অভিভাবকদের দ্বারা পরিত্যক্ত।

অনাথ শিশুদের দত্তক দেওয়ার জন্য সারা দেশে রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকৃত বহু এডপশান এজেন্সি। এদের তদারকির জন্য প্রত্যেক রাজ্যে রয়েছে চিলড্রেন ওয়েলফেয়ার কমিটি। জেলায় জেলায় রয়েছে শিশু সুরক্ষা অফিসারও।

তবে ভারতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দত্তক দেওয়ার আইনটি কঠোর, জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বিদেশি দম্পতিরা দালালের সাহায্য নেয় বলে অভিযোগ।

বিমলা শিশু গৃহের মতো হোমগুলি অর্থের বিনিময়ে অবৈধ উপায়ে চিকিৎসক ও সরকারি অফিসারদের সহযোগিতায় কাগজপত্র তৈরি করে দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে বলে জানিয়েছেন এই ধরনের একটি কাজে যুক্ত সংস্থার এক কর্মী । তাঁর মতে, ইচ্ছেমতো দাবি করা যায় বলে ভারতীয়দের চেয়ে বিদেশিদের কাছে দত্তক দেওয়ায় হোমগুলোর আগ্রহ বেশি।

শিশু পাচার প্রতিরোধের কাজে যুক্ত সমাজকর্মী সংহিতা ঘোষ বেনারকে বলেন, “গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্য শিবির করে দরিদ্র গর্ভবতী মহিলাদের চিহ্নিত করা হয়। দত্তক দেওয়া হবে প্রতিশ্রুতিতে টাকার টোপ দিয়ে শিশু জন্মের পর শিশু তুলে দিতে বলা হয়। অবিবাহিত গর্ভবতী মহিলাদেরও টার্গেট করে টোপ দেওয়া হয়। বহু নার্সিং হোম এই কাজে যুক্ত। এ জন্য একটি দালাল চক্র ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাজ্যে।

কেন্দ্রের সতর্কতায় তদন্ত শুরু

গত বছরের জুন মাসে সেন্ট্রাল অ্যাডাপশন রিসোর্স অথোরিটি (কারা) চন্দনা চক্রবর্তীর হোমের বিরুদ্ধে তথ্য গরমিলের অভিযোগ জানায়। সেই সঙ্গে হোমের শিশুদের সরিয়ে নেবার কথা জানানো হয়।

অভিযোগ আসার পরই চিকিৎসক দেবাশিষ চন্দকে দিয়ে ১৭টি শিশুর ভুয়া নথি বানিয়ে জানানো হয়, শিশুগুলোকে প্রকৃত বাবা মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য শিশু সুরক্ষা আধিকারিক মৃণাল ঘোষ চাইল্ড অ্যাডাপশন রিসোর্স অথোরিটির ওয়েব পোর্টালে আপলোড করেছিলেন বলে অভিযোগ।

তবে রিসোর্স অথোরিটি এই চাতুরী ধরে ফেলে। এরপর গত ২১ জানুয়ারি রিসোর্স অথোরিটি গোটা ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নজরে এনে ব্যবস্থা নিতে বলে।

তদন্তে নেমে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি জলপাইগুড়ির কোতোয়ালি থানায় অভিযোগ দায়ের করে। অবশ্য গত বছর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন হোমের তথ্যও খতিয়ে দেখা শুরু হয় বলে জানান নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তরের এক কর্তা। এর পরেই উঠে আসে দত্তক দেওয়ার নামে শিশু পাচারের নানা কাহিনি।

উত্তরবঙ্গের ঘটনার তদন্তে এসে কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিশু সুরক্ষা আয়োগের দুই প্রতিনিধি গত বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘‘দু’বছর আগেই পাচার সংক্রান্ত অভিযোগ পেয়েছিল প্রশাসন। তার পরেও চুপ থেকেছে৷ আর এখন এত বড় ব্যর্থতাকে চাপতে ও আধিকারিকদের বাঁচাতেই রাজনৈতিক রং লাগানো হচ্ছে।”

শিশু পাচার বন্ধে বাড়াতে হবে সচেতনতা

পাচার বন্ধে দত্তক দেওয়ার সরকার স্বীকৃত হোমগুলোর ওপর সরকারের নজরদারি জরুরি বলে মনে করেন আইনত দত্তক দেওয়ার কাজে যুক্ত আইনজীবী চিত্রভানু গুপ্ত।

পশ্চিমবঙ্গের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা বেনারকে বলেছেন, “হোমগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সিআইডিও তদন্ত করছে।”

বিশিষ্ট মনোবিদ অধ্যাপক ডাঃ গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বেনারকে বলেছেন “শিশু পাচারকে প্রতিরোধ করতে হলে তৃণমূল স্তরে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সেই সঙ্গে অভিভাবকদের বোঝাতে হবে যে তারা শিশু বিক্রির মাধ্যমে সামাজিক অপরাধ করছেন। আর দারিদ্র্য থেকেই তো এই সমস্যার সৃষ্টি।”

দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শিশু পাচারের মতো ঘৃণ্য কাজে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি বলেও জানান তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।