বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন নিয়ে ইইউ পার্লামেন্টের উদ্বেগ, সরকার নীরব

প্রাপ্তি রহমান
2017.04.07
ঢাকা
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার হরহিরা গ্রামে নবম শ্রেণির ছাত্রী রিতু খাতুনের বিয়ে বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার হরহিরা গ্রামে নবম শ্রেণির ছাত্রী রিতু খাতুনের বিয়ে বন্ধ করে দেয় উপজেলা প্রশাসন। মার্চ ০৬, ২০১৭।
প্রাপ্তি রহমান/বেনারনিউজ

‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে’ ১৮ বছরের নিচে কন্যা শিশুদের বিয়ের বিধান রাখা নিয়ে চলমান বিতর্কের মধ্যে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ পাস হয়। এর এক মাসের মাথায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট বাংলাদেশ সরকারকে নতুন আইনের ফাঁকফোকর বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। তবে সরকার এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

ইইউ পার্লামেন্টের সব সদস্য গত ৫ এপ্রিল একমত হয়েছেন যে, নতুন আইনে থাকা ফাঁকফোকরে বাল্যবিয়ে বৈধতা পেতে পারে। বাল্য বিয়ে বন্ধে বাংলাদেশ সরকারের যে উদ্যোগ তা-ও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

উল্লেখ্য, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭র ১৯ দফা নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত। ওই দফায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছু থাকুক না কেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশক্রমে এবং মাতা-পিতার সম্মতিক্রমে বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বিয়ে সম্পাদিত হলে তা এই আইনের অধীন অপরাধ বলে গণ্য হবে না’।

বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি ইইউ পার্লামেন্টের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

“আমি এখনই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। সরকার এ বিষয়ে তার আগের অবস্থানে আছে। যে কেউ চাইলেই অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুকে বিয়ে দিতে পারবেন বিষয়টি এমন নয়। এটি আদালতের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে,” মেহের আফরোজ চুমকি শুক্রবার বেনারকে বলেন।

এ দিকে একই উদ্বেগ থেকে গত ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) ও নারীপক্ষ হাইকোর্টে ১৯ দফার বিষয়ে কৈফিয়ত চেয়ে রিট আবেদন করে।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে গার্ল সামিটে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ১৫-১৮ বছর বয়সের মধ্যে বিয়ের হার ২০২১ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশে নামিয়ে আনবে। ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করবে। এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৮ বছরের নিচে বিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করবে। বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনের ফাঁকফোকরগুলো সরকারের এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

ইইউ পার্লামেন্ট যা বলছে

ইইউ পার্লামেন্ট বলছে, বিতর্কিত ১৯ দফা যুক্ত হওয়ায় ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের মতো ঝুঁকি বাড়তে পারে।

ইইউ পার্লামেন্ট কেন বাংলাদেশের এই আইন নিয়ে কথা বলছে তার পক্ষে যুক্তিও উপস্থাপন করা হয়েছে। পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত তথ্য ও ভিডিও রয়েছে।

ইইউ পার্লামেন্ট বলেছে, ‘সর্বোত্তম স্বার্থ’ বিবেচনায় বিয়ের যে বিধান রাখা হয়েছে, সেই বিধানে সর্বোত্তম স্বার্থ কী তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

ইইউ পার্লামেন্টের এই উদ্বেগ আসলে কী বার্তা বহন করে এমন প্রশ্নে অ্যাকশন এইডের এ দেশীয় পরিচালক ফারাহ কবীর বলেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিষয়ে কথা বলতেই পারে।

“বহু বছর ধরে দেশের উন্নয়ন খাতে ইইউ বাংলাদেশকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সে দিক থেকে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কোনো সভ্য দেশে বিশেষ বিধানে বিয়ের সুযোগ থাকতে পারে না,” ফারাহ কবির শুক্রবার বেনারকে বলেন।

ইইউ পার্লামেন্ট আইনটি পাশের পর চট্টগ্রামে ১৪ বছরের শিশুর সঙ্গে ২৫ বছরের যুবকের বিয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছে। ওই শিশু ১৩ বছর বয়সে ধর্ষণের শিকার হয়ে গর্ভধারণ করে। আইনটি পাশের পর ধর্ষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

ইইউ পার্লামেন্ট বলছে, ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ের এই বিধান শিশুটির মানবাধিকার ক্ষুণ্ন করে। এতে করে ন্যায়বিচার ক্ষুণ্ন হয়।

বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই বিশেষ বিধানের বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে এবং অবশ্যই ১৬ বছরের নিচে বিয়ে নিষিদ্ধ করতে হবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টে ২৮ টি দেশের ৭৫১জন সদস্য সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের আইনি ক্ষমতা ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের গণতন্ত্র, মত প্রকাশের অধিকার ও মানবাধিকার পরিস্থিতি পার্লামেন্ট আলোচনা করে। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের কর্মসূচি রয়েছে, সেসব দেশেও প্রভাব রেখে থাকে।

বিএনডব্লিউএলএ ও নারী পক্ষের রিট

গত ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি ও নারীপক্ষ বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী এবং জেবিএম হাসানের বেঞ্চে রিট করে। রিট আবেদনটি এখন শুনানির অপেক্ষায়। আবেদনে সংগঠন দুটি যুক্তি তুলে ধরেছে যে, আইনের ১৯ দফার বিশেষ বিধান অন্যান্য ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

দুটি সংগঠনের পক্ষে রিট আবেদন করেন ফৌজিয়া করিম ফিরোজ। ১৯ দফা কেন আইনের মূল ধারণার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তার ব্যাখ্যা করেন।

“বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ ও ১৯ দফা বাংলাদেশ সিডও সহ যেসব আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সাক্ষর করেছে এবং দেশে যেসব আইন আছে তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য জানতে চাইছি। এতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়কে দায়বদ্ধ করা হয়েছে,” ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন।

নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলোর দাবির মুখে নতুন আইন হয়। এর আগের আইনটি ছিল ১৯২৯ সালে। নতুন আইনে বিশেষ বিধান রাখার বিষয়ে সংগঠনগুলো বছর খানেকেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে। তারপরও সরকার বিশেষ বিধান রেখেই আইন পাস করে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।