বাল্যবিবাহ রুখে দিচ্ছে বাংলার কিশোরীরা

জেসমিন পাপড়ি
2017.04.26
ঢাকা
নিজেদের স্কুলের সামনে ‘ঘাসফুল'র সাত সাহসী কিশোরী, নান্দাইল, ময়মনসিংহ। নিজেদের স্কুলের সামনে ‘ঘাসফুল'র সাত সাহসী কিশোরী, নান্দাইল, ময়মনসিংহ। এপ্রিল ১৬, ২০১৭।
স্টার মেইল

বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়ার মাধ্যমে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে বাংলাদেশের একদল কিশোরী। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় ‘ঘাসফুল’ নামক এই সংগঠনের মেয়েরা এখন পুরো দেশের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।

নান্দাইল পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির চারজন এবং নবম শ্রেণির তিনজন মিলে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে এবং মেয়েদের উত্ত্যক্তকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যে বছরখানেক আগে সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু করে। এসব ছাত্রীদের বয়স ১৩-১৪ বছর। সংগঠনটি গঠনের কাজে সহায়তা দেয় আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ডভিশন নান্দাইল কার্যালয়।

এ বছরই সংগঠনটি তিনটি বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছে। তাঁদের এই সাহসী কাজ দেশ জুড়ে প্রশংসিত হচ্ছে।

নিজের বাল্যবিবাহ রুখে গত ২৯ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন ঝালকাঠির মেয়ে শারমিন আক্তার। শারমিনের সেই ভূমিকাও তাঁদেরকে অনুপ্রাণিত করছে বলে জানিয়েছে ঘাসফুল সদস্যরা। এখন সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ছেলেরাও।

বাল্যবিবাহ রোধে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করায় ঘাসফড়িংয়ের সদস্যদের পুরস্কৃত করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

ঘাসফুলের সদস্য সানজিদা ইসলাম বেনারকে বলেন, “আমরা চাই না কোনো মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার হোক। তাই এ ধরনের কোনো খবর পেলে আমরা শুরুতে অভিভাবকদের বোঝানোর চেষ্টা করি। অনেক সময় তারা আমাদের ভুল বোঝেন। কিন্তু আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই। শেষমেশ কাজ না হলে প্রশাসনের সহায়তা নিই।”

তবে শুধু নান্দাইল নয়, একদিন সারা দেশেই বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে এ ধরনের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়বে সে আশাও ব্যক্ত করেন এই কিশোরী।

সংগঠনটির অপর সদস্য জান্নাতুল আক্তার বেনারকে বলেন, “শুরুতে আমরা কয়েকজন মেয়েরা ঘাসফুলের কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু এখন আমাদের সঙ্গে ছেলেরাও যোগ দিচ্ছে।”

এসব কিশোরীদের কার্যক্রমের প্রশংসা করে নান্দাইল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. হাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন “কোথাও বাল্য বিবাহ হলে এই কিশোরীরা আমাদের খবর দেয়, আমরাও পুলিশ নিয়ে সেখানে হাজির হয়ে এ ধরনের অপরাধ কর্ম বন্ধ করে থাকি।”

শুধু ঘাসফুলের মতো সংগঠনের সাহায্যে নয়, কিশোরীদের নিজ উদ্যোগেও একের পর এক বাল্য বিবাহ রুখে দেওয়ার খবর চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশে। গত এক মাসে সংবাদমাধ্যমে এমন বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশ হওয়ায় বিষয়টি অন্যতম সামাজিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।

২০১৭ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ১২টি বিয়ের আয়োজন নিজের বা প্রশাসনের চেষ্টায় ঠেকানোর খবর দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। এ ধরনের সব খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয় না বলে প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি। স্থানীয় প্রশাসনও কিছু বিয়ে আটকে দিচ্ছে। জেল–জরিমানা করছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গত মার্চে সরকারের প্রণয়ন করা আইনটি মানবাধিকারকর্মী ও বেসরকারি সংস্থাগুলো মেনে নিতে পারেননি। ওই আইনে বিশেষ পরিস্থিতিতে বিয়ের বিধান রাখা হয়েছে, যা ইতিমধ্যে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে উচ্চ আদালতে। এরই মধ্যে একের পর এক সংবাদমাধ্যমে বাল্য বিয়ে ঠেকানোর খবর প্রকাশ হচ্ছে।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সায়মা আক্তার বেনারকে বলেন, “দেশের প্রচলিত নিয়মে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়া আইনত দণ্ডণীয়। তাই যেকোনো মূল্যে বাল্য বিবাহ বন্ধ করাই প্রশাসনের কাজ।”

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বেনারকে বলেন, “কিশোরীদের একের পর এক বাল্যবিবাহ রুখে দেওয়ার ঘটনা সম্প্রতি বিতর্কিত ধারাসহ পাশ হওয়া বাল্যবিয়ে আইনের সঠিক জবাব। এর মানে দেশে পরিবর্তন আসবেই।”

বাল্যবিয়ে ঠেকানোর কিছু দৃষ্টান্ত

ঘাসফুলের তিনটি বাল্যবিয়ে রুখে দেওয়ার খবরের পাশাপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ এপ্রিল প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে নিজের বাল্যবিয়ে বন্ধ করে ময়মনসিংহের ত্রিশালের সোনিয়া আক্তার (১৩)।

গত ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার নবম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া খানম সমাপ্তি, গত ৩১ মার্চ নীলফামারীর ​ডোমারে ফাতেমা, গত ২৭ মার্চ নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী কাকলী আক্তার এবং গত ১৮ এপ্রিল ময়মনসিংহের নান্দাইলে এক কিশোরী বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পায়।

তবে বাল্যবিয়ের সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।

গত ২৯ জানুয়ারি বরিশালের হিজলা সদর উপজেলায় বাল্যবিবাহের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বৈশাখী আক্তার (১৪) নামে ৮ম শ্রেণির এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুরে গত ১৭ এ​প্রিল বাল্যবিয়ে ঠেকাতে না পেরে আত্মহত্যা করে নবম শ্রেণির ছাত্রী মার্জিয়া সুলতানা।

মাঠপর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কিছু বাল্যবিয়ে আটকে দিচ্ছে। টাঙ্গাইল ও নীলফামারীতে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে সাম্প্রতিক সময়ে দুটি বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়েছে।

পরিবর্তনের প্রত্যাশা

কিশোরীদের নিজেদের বাল্যবিয়ে রুখে দেওয়ার খবর বিশেষভাবে আলোড়িত করেছে শারমিনকে। যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডির কাছ থেকে পুরস্কার নেওয়া এই কিশোরী বেনারকে বলেন, “আমি বারবার বলেছি মেয়েরা সাহস নিয়ে এগিয়ে আসুক। আমাদের আইন আছে, প্রশাসন আছে, তাদের সহায়তা নিয়ে নিজেদের পক্ষে বাল্যবিবাহ ঠেকানো সম্ভব।”

তাঁর মতে, এভাবে সব মেয়েরা সাহসী হলে দেশে একদিন আর কোনো বাল্যবিবাহ থাকবে না।

আইনজীবী সালমা আলী বলেন, বাবা-মা মেয়েদের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক সময় অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। তাই সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক জরুরি, তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।

তাঁর মতে, স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার পাশাপাশি বাবা-মা, অভিভাবকদের ও বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

৭৩ শতাংশের বিয়ে আঠারোর আগেই

বাংলাদেশে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ৭৩ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়। ‘এশিয়া চাইল্ড ম্যারেজ ইনিশিয়েটিভ’ শীর্ষক জরিপের এক প্রতিবেদন এই তথ্য প্রকাশ করে ২০১৫ সালের নভেম্বরে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ওই জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সেই ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়।

‘আই অ্যাম এ গার্ল’ ক্যাম্পেইনের আওতায় প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ২০১০ সাল থেকে এশিয়া চাইল্ড ম্যারেজ ইনিশিয়েটিভের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

শিক্ষার হার বাড়াই কারণ

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বেগম রেবেকা মমিন মনে করেন, দেশে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে এবং এর ফলে মানুষের সচেতনতাও বেড়েছে। বাল্য বিবাহ রুখে দাঁড়ানোর এটাই অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি।

“শিক্ষিত মেয়েরা স্বাবলম্বী হতে চায়। তখন তারা অল্প বয়সে বিয়ে করে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে চায় না। এমনকি মাদ্রাসার মেয়েরাও পড়ালেখা শেষ করেই তবে বিয়ের কথা বলে এখন। বিষয়টি খুবই ইতিবাচক,” বেনারকে বলেন রেবে​কা মমিন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।