চীনা মুদ্রায় বাংলাদেশে তাৎক্ষণিক লেনদেন নিষ্পত্তির উদ্যোগ

রিয়াদ হোসেন
2024.01.26
ঢাকা
চীনা মুদ্রায় বাংলাদেশে তাৎক্ষণিক  লেনদেন নিষ্পত্তির উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের ভাইস মিনিস্টার সান হাইয়ান। গতকাল রাজধানীতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে। ২৫ জানুয়ারি ২০২৪।
[সৌজন্যে: বাসস]

বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে যে কোনো লেনদেন চীনের মুদ্রায় তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি (আরটিজিএস) করতে পারবে। ব্যাংকিং সেক্টরে এই পদ্ধতি 'রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট' বা আরটিজিএস নামে পরিচিত।

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক মো. শরাফত উল্লাহ খান স্বাক্ষরিত সার্কুলারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মার্কিন ডলারের পাশাপাশি গত বছর লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানের ইয়েন, ইউরো ও কানাডিয়ান ডলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

চীনের সঙ্গে ব্যবসা রয়েছে এমন ব্যবসায়ীরা ইউয়ানে লেনদেনের উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা বেনারকে বলেন, “এখন আর কোনো লেনদেনে কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে না।  সঙ্গে সঙ্গে লেনদেন হবে, ফলে ব্যবসায়ীরা উৎসাহিত হবেন।”

তিনি বলেন, “চীনা মুদ্রায় লেনদেন বাড়লে ডলারের ব্যবহার কমবে এবং ডলারের দর ওঠা-নামার ঝুঁকি থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।  এতে চীনের ব্যবসায়ীরাও বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে আগ্রহী হবেন।”

একই মত দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান।

অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (রেপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বেনারকে বলেন, “রপ্তানি আয়ের অংশ ছাড়াও চীন থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ পাচ্ছে এবং কেনাকাটা ওই মুদ্রায় করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো উৎসাহিত হবে।”

ইতোমধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করব।”

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন।  বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশ এক হাজার ৭৮২ কোটি ডলারের সমপরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে।

বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য চীনে রপ্তানি করেছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে বাংলাদেশে ডলার সংকট দেখা দেয়। ডলারের বিপরীতে কয়েক ধাপে টাকার দর কমানো হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের উপায় হিসেবে গত বছরের সেপ্টেম্বরে চীনা মুদ্রায় লেনদেনের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

এবার চালু হলো চীনা মুদ্রায় তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তির সুযোগ।

বাংলাদেশ এমন সময় এই উদ্যোগ নিলো, যখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিভাগের ভাইস মিনিস্টার সান হাইয়ান বাংলাদেশ সফর করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি বৃহস্পতিবার সাক্ষাৎ করেছেন। সাক্ষাতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের কাছ থেকে আরও বেশি সহযোগিতা চেয়েছেন বলে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসস এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।

যেভাবে চীনা মুদ্রায় লেনদেন

“আমাদের ব্যাংকে যদি ইউয়ানের কোনো লেনদেনের উদ্ভব হয়, তখন অন্য ব্যাংকের সঙ্গে আরটিজিএস ব্যবহার করে দ্রুত লেনদেন নিষ্পত্তি করা যাবে,” বলেন মাহবুবুর রহমান।

তিনি আরও বলেন, “এত দিন ইউয়ানের ক্ষেত্রে এই সুবিধা না থাকায় লেনদেন নিষ্পত্তি হতে পাঁচ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যেত।”

চীনের মুদ্রায় তাৎক্ষণিক লেনদেনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হককে বেনারের পক্ষ থেকে ফোন করা এবং ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

জাতীয় দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার এক প্রতিবেদনে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “এতদিন ব্যাংকগুলো ফরেন ডিমান্ড ড্রাফটের (এফডিডি) মাধ্যমে চীনের মুদ্রায় লেনদেন করতে পারতো, যা ছিল ম্যানুয়াল এবং এতে অনেক নথিপত্রের কাজ ছিল।

“এখন স্থানীয় একটি ব্যাংক অন্য ব্যাংককে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে দ্রুততম সময়ে লেনদেন নিষ্পত্তি করতে পারবে,” যোগ করেন মেজবাউল।

বেসরকারি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “গত বছর পাঁচটি বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্গে আরটিজিএস চালু হওয়ার পর এফডিডির মাধ্যমে কার্যত ইউয়ানের নিষ্পত্তি বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায় এখন ইউয়ান যুক্ত হওয়ায় স্থানীয় কেনাকাটার জন্য কোনো ব্যাংকে ঋণপত্র খুললে, অন্য কোনো ব্যাংকে চীনের মুদ্রা থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে লেনদেন সম্পন্ন হবে।”

অর্থনীতিবিদ ড. রাজ্জাক বলেন, “চীনে বাংলাদেশের যে পরিমাণ রপ্তানি হয় (৬৮ কোটি ডলার) সর্বোচ্চ ওই পরিমাণ ইউয়ানে লেনদেনের সুযোগ থাকবে।”

এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চীনের ঋণের অর্থ ও সেখানকার বিনিয়োগকারীরা চীনা মুদ্রায় বিনিয়োগ নিয়ে আসলে এই মুদ্রায় লেনদেন বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে।

“চীনা মুদ্রায় লেনদেন যদি ব্যবসায়ীদের জন্য ডলারের চেয়ে সাশ্রয়ী হয়, তাহলে এটি জনপ্রিয়তা পেতে পারে এবং উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবে,” আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

গত বছরের এপ্রিলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে নেয়া ঋণ চীনা মুদ্রা ইউয়ানে পরিশোধ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।  এ ব্যাপারে ঢাকা ও মস্কোর মধ্যে সমঝোতা হলেও ইউয়ানে পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি।  তবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব একটি ব্যাংকের হিসাবে কিস্তির টাকা নিয়মিত জমা রাখা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।