দ্বিতীয় পারমাণবিক কেন্দ্রের কাজ চায় তিনটি চীনা কোম্পানী

কামরান রেজা চৌধুরী
2019.05.09
ঢাকা
190509_BD_Chiana-NPP_620.jpg নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
[সৌজন্যে: রোসাটম]

সরকার ঘোষিত দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ পেতে জোর তৎপরতা শুরু করেছে চীনের কোম্পানিগুলো।

যদিও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি কত ক্ষমতাসম্পন্ন হবে অথবা কোন স্থানে নির্মিত হবে সে বিষয়ে কিছুই ঠিক হয়নি বলে বেনারকে জানিয়েছেন পরমাণু শক্তি কমিশনের (বিএইসি) চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক।

অথচ ইতিমধ্যে তিনটি চীনা কোম্পানি তাঁর সাথে দেখা করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তবে তাদের পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের কাজ দিলে ভারত-চীনের আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে পারে বাংলাদেশ, এমন মত বিশেষজ্ঞদের।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশে চীনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে।

বিএইসি চেয়ারম্যান বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক জনসভায় দক্ষিণাঞ্চলে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দেন। সেই অনুযায়ী গত বছর সরকারের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য স্থান বের করার জন্য পরমাণু শক্তি কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।”

বর্তমানে কমিশন স্থান নির্বাচনের কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, “দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কারা নির্মাণ করবে সেবিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ইতোমধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগ্রহ প্রকাশ করে তিনটি চাইনিজ কোম্পানির প্রতিনিধি আমার সাথে দেখা করেছেন।”

“প্রথমে চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার কো-অপারেশন নামক একটি প্রতিষ্ঠান আমার সাথে দেখা করে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করে। পরে আরও দুটি কোম্পানি আমার কাছে এসে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার আগ্রহ প্রকাশ করতে।”

অন্য দুটি কোম্পানির নাম না বললেও কমিশন চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, “মূলত চীনারাই আমার কাছে এসেছিল।”

“চীনারা বলেছে তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পারমাণবিক কেন্দ্রটি নির্মাণ করবে,” বলেন মাহবুবুল।

যা জানালেন প্রকল্প পরিচালক

দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য একজন প্রকল্প পরিচালকও (পিডি) নিয়োগ করেছে পরমাণু শক্তি কমিশন।

পিডি মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “কেন্দ্রটি কত মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন হবে বা কারা নির্মাণ করবে সে ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে প্রকল্পটি দক্ষিণাঞ্চলে হবে সেটি নিশ্চিত।”

“আমি যতটুকু জানি, চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং মন্ত্রী ও আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি লিখেছে,” যোগ করেন তিনি।

পিডি বলেন, “আমরা বর্তমানে প্রকল্পটির জন্য স্থান নির্বাচন করছি। আমরা বৃহত্তর বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের কয়েকটি স্থানকে বিবেচনার কথা মাথায় রেখে কাজ করছি।”

প্রস্তাবিত স্থানের মধ্যে বরগুনার পদ্মারচর, পাথরঘাটা, লালদিয়ারচর, নিশানবাড়ি, আমতলা, বরিশালের হিজলা উপজেলার চরমেঘা, পটুয়াখালী জেলার নওডোবা রাঙ্গাবালি, চরমন্তাজ, সোনারচর, নোয়াখালী জেলার উরিরচর, চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং কক্সবাজার জেলার সোনাদিয়াও রয়েছে বলে জানান মিজানুর।

যেভাবে এসেছে রাশিয়া

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু নেই।

১৯৬০ এর দশকে পাবনা জেলার রূপপুরে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ হাতে নেয় পাকিস্তান সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইও শেষ করে তারা।

তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। স্বাধীন হওয়ার পর কোনো সরকারই সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণের কাজে হাত দেয়নি।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই এই কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়ার পারমাণবিক সংস্থা রোসাটমের সাথে চুক্তি করে তারা।

প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ এবং রাশিয়া যৌথভাবে অর্থায়ন করছে।

বর্তমানে প্রকল্পের খরচ প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বলে জানিয়েছেন পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক। তিনি বলেন, “রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা হবে দৈনিক ২৪০০ মেগাওয়াট।”

“আমাদের আশা, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে রূপপুর কেন্দ্র থেকে বিদুৎ উৎপাদন শুরু হবে। রাশিয়া এই কেন্দ্রের বর্জ্য তাদের দেশে নিয়ে যাবে,” যোগ করেন বিএইসি চেয়ারম্যান।

অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা

অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বেনারকে বলেন, “পদ্মাসেতুসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চাইনিজ কোম্পানিগুলো। এ দেশে চীনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা এখন পারমাণবিক কেন্দ্র বাস্তবায়ন করতে চায়।”

তাঁর মতে, এই পারমাণবিক কেন্দ্রের কাজের সাথে আন্তর্জাতিক রাজনীতি জড়িত।

“আমাদের মনে রাখতে হবে চীনকে পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ করতে দিলে ভারত ও চীনের রাজনীতির মধ্যে পড়ে যেতে পারে বাংলাদেশ,” বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।

জিল্লুর আরও বলেন, “চীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার। তবে তাদের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।”

বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিভিন্ন পণ্য আমদানি করেছে।

আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বলছে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালে মার্চ পর্যন্ত চীনে ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।

গত ১৬ মার্চ ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে চীনা রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং ঝো বলেন, প্রায় ২০০ বড় এবং ২০০ ক্ষুদ্র ও মাঝারি চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে কাজ করছে।

বাংলাদেশ চীনের ২৭টি প্রকল্প

বাংলাদেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে চীনের অর্থায়নে মোট ২৭টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি প্রকল্প চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ সম্পর্কিত বলে বেনারকে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।

এদিকে বেল্ট ও রোড উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশে চীন ১১টি প্রকল্পে অর্থায়ন করছে বলে বুধাবার ঢাকায় ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেদের জন্য আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জানান চীনা রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং ঝু। তবে তিনি প্রকল্পগুলোর নাম বলেননি।

অর্থ মন্ত্রণালয়র থেকে পাওয়া তালিকা অনুযায়ী বেল্ড অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অধীন দশটি চলমান প্রকল্প হলো: পদ্মা ব্রীজ রেল সংযোগ প্রকল্প, ঢাকা-সিলেট চারলেন মহাসড়ক প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্প, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ডুয়েল গেজ রেল প্রকল্প, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েল গেজ রেল প্রকল্প, সীতাকূণ্ড-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মেরিনড্রাইভ নির্মাণ প্রকল্প, মংলা বন্দরের সুবিধা আধুনিকীকরণ প্রকল্প, আখাউড়া-সিলেট মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরণ প্রকল্প, এবং গাজীপুরের ধীরাশ্রম রেল স্টেশনে নতুন ইনল্যাণ্ড কন্টেইনার ডিপো নির্মাণ প্রকল্প।

প্রসঙ্গত বাংলাদেশ নিজেদের প্রকল্পগুলোর সাথে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ’ কথাটি ব্যবহার করে না। বরং প্রকল্পগুলোর স্বতন্ত্র নামই ব্যবহার করে থাকে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।