ভারতীয় ভিসা কঠোর হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য পর্যটনে সুযোগ নিচ্ছে চীন
2025.03.19
ঢাকা

বাংলাদেশিদের জন্য ভারতের ভিসা সংকোচন নীতিকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগাতে শুরু করেছে চীন। কেবল বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা দিতে কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতালকে নির্দিষ্ট করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ।
আগামী ২৬ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের সময় স্বাস্থ্যসেবা ও পর্যটন বিষয়ক এসব সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া শাখার মহাপরিচালক মোহাম্মদ নূরে আলম গত মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, স্বাস্থ্য পর্যটন খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ও চীন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ২৬ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের সময় দুই দেশের স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হবে।
তিনি বলেন, “কুনমিং শহরের চারটি হাসপাতালকে বাংলাদেশিদের সেবা দিতে নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া, ঢাকায় চীনা অর্থায়নে একটি বৃহৎ হাসপাতাল স্থাপনের লক্ষ্যে আলোচনা চলছে।”
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর দুই দেশের সম্পর্কে অবনতি হয়। ভারতীয় ভিসা কঠোর করায় বিপাকে পড়েন বাংলাদেশের হাজার হাজার রোগী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সংকোচন করার প্রেক্ষিতে জানুয়ারিতে চীন সফরে গিয়ে বাংলাদেশিদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে আহ্বান জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
এই প্রেক্ষিতে ১০ মার্চ বাংলাদেশ থেকে মেডিকেল পর্যটনের জন্য একটি প্রতিনিধিদল চীনের কুনমিং শহরে যান। এর মধ্যে রয়েছে রোগী এবং চিকিৎসকরাও।
পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দীন এবং বাংলাদেশে চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন প্রতিনিধিদলকে বিমানবন্দরে বিদায় জানান।
সেখানে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সাংবাদিকদের জানান, কুনমিংয়ের ফার্স্ট পিপলস্ হসপিটাল অব ইউনান প্রভিন্স, ফার্স্ট অ্যাফিলিয়েটেড হসপিটাল অব কুনমিং মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, ইউনান ফুওয়াই কার্ডিওভাস্কুলার হসপিটাল এবং ইউনান ক্যান্সার হসপিটাল বাংলাদেশিদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এসব বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসে ইমেইল ও বার্তা পাঠানো হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনও জবাব পাওয়া যায়নি।
তবে চীনাদের এই উদ্যোগ কতটুকু সফল হবে সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
চীনে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বেনারকে বলেন, কুনমিংয়ে বাংলাদেশিদের জন্য হাসপাতাল নির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্য হলো ভারতের ভিসা সংকোচনের পর স্বাস্থ্যখাতে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা কাজে লাগানো।
তিনি বলেন, “চীন তো আর বিনা পয়সায় আমাদের সেবা দেবে না। আবার আমাদেরও সেবা দরকার। এটি দুই দেশের জন্যই সুবিধা।”
রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ বলেন, “তবে চীনে বিদেশিদের জন্য স্বাস্থ্য সেবার খরচ আকাশচুম্বী। অপরদিকে তাদের নাগরিকদের জন্য হাসপাতালে খরচ খুব কম। এগুলোতে ভর্তুকি দেওয়া হয়। আমি নিশ্চিত না, সেখানে খরচ কেমন পড়বে।”
সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, চীনারা ঢাকায় একটি হাসপাতাল করতে চায় এবং ইতোমধ্যে উত্তরাঞ্চলে একটি বড় হাসপাতাল স্থাপনের কাজ শুরু করেছে।
রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ বলেন, “বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভূটান এবং ভারতের রোগীরাও যেনো সেখান থেকে সেবা পায়, সেজন্যই উত্তরাঞ্চলের ওই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “ভারত ও চীনাদের মধ্যে কৌশলগত দিক থেকে একটি পার্থক্য রয়েছে। ভারতীয়রা চায় বাংলাদেশিরা সেখানে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করুক। অন্যদিকে চীনারা চায় বাংলাদেশে হাসপাতাল স্থাপন করে স্বাস্থ্যসেবা দিতে।”
বাংলাদেশে কম খরচে উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ায় প্রতিবছর লাখ লাখ বাংলাদেশি প্রধানত ভারত ও থাইল্যান্ড যান। সচ্ছল ব্যক্তিরা সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাজ্য গিয়ে চিকিৎসা করান। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই বিদেশে যান চিকিৎসা নিতে।
সরকারি হিসাবে, প্রতিবছর কমপক্ষে আড়াই লাখ বাংলাদেশি স্বাস্থ্য পর্যটনের জন্য ভারত ভ্রমণ করেন। গত ডিসেম্বরে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ. মনসুর বলেন, প্রতিবছর চিকিৎসা পর্যটন খাতে পাঁচ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়।
পর্যটন ও বেসরকারি বিমান বিষয়ক পর্যবেক্ষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বেনারকে বলেন, ভারতের ভিসা সংকোচনের ফলে বাংলাদেশ থেকে রোগী আকৃষ্ট করতে সুপরিকল্পিত কৌশল অবলম্বন করেছে চীন।
তিনি বলেন, “তারা বাংলাদেশিদের জন্য কুনমিংয়ের চারটি হাসপাতালকে নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে মেডিকেল ভিসার জন্য সময় লাগে গড়ে সাত দিন। তারা বাংলাদেশিদের জন্য মেডিকেল ভিসা দ্রুততম সময়ে প্রসেস করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।”

ওয়াহিদুল আলম বলেন, ঢাকা থেকে কুনমিং যেতে আড়াই ঘন্টার কম সময় লাগে। একাধিক চীনা কোম্পানি ঢাকা থেকে কুনমিংয়ে প্রতিদিন ফ্লাইট পরিচালনা করে। বিমান এবং ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সও ফ্লাইট পরিচালনা করে।
তিনি বলেন, “চীনে স্বাস্থ্যসেবার মান ভালো। ভারতের চেয়ে খরচ বেশি হলেও সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককের চেয়ে কম। তবে চীনে স্বাস্থ্যসেবা পেতে প্রধান বাধা হলো ভাষাগত সমস্যা, ইতিমধ্যে চীনারা বাংলাদেশি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়োগ করছে, আবার অনুবাদকও রাখছে।”
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “ভারত ভিসা কঠোর করায় চীনারা সেই স্থান পূরণের চেষ্টা করছে। মানুষ সেখানে যাবে, কারণ তাদের সেবা দরকার।”
তিনি বলেন, “আমি ঠিক নিশ্চিত না, চীনারা ভারতের চেয়ে কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবে কি না। বাংলাদেশ থেকে কম খরচে সড়কপথে ভারতে যাওয়া যায়। কিন্তু কুনমিংয়ে সড়ক পথে যাওয়া যায় না। বিমানের খরচও একটি বড় বিষয়।”
“তবে আমি মনে করি, বিদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে উন্নত করতে হবে। আমাদের দেশের আট বিভাগে আটটি বড় উন্নত হাসপাতাল স্থাপন করা গেলে সেখান থেকে ওই অঞ্চলের মানুষরা সহজে সেবা পাবেন। মানুষ আর বিদেশে যেতে চাইবে না,” মনে করেন তিনি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “আমার ধারণা, ভারত দ্রুত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সংকোচন নীতি তুলে নেবে এবং সেখান থেকে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার সুযোগ সহজ করবে।”
২৮ মার্চ ইউনূস-জিনপিং দ্বিপক্ষীয় বৈঠক
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন চীন সফরের মাধ্যমে সরকার দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায় বলে গত রোববার এক ব্রিফিংয়ে জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা ২৬ মার্চ চীন সফরে যাবেন, ২৮ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সঙ্গে বৈঠক করবেন।
প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টার এই সফর বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চীনের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের (সিইও) সঙ্গে বৈঠক করবেন। চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগ করবে বলে তিনি আশা করছেন।
শফিকুল আলম বলেন, “বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের মান উন্নয়ন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার এই সফরে আলোচনা হবে। মুহাম্মদ ইউনূস চীনের হাইটেক পার্ক পরিদর্শন করবেন। এ ছাড়া পিকিং ইউনিভার্সিটিতে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন তিনি।”