ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প: বাংলাদেশ ও ভারতে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা
2020.12.07

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ নদী ব্রহ্মপুত্রের উৎস ইয়ারলং সাংপো নদীর ওপর চীনের প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিম্ন অববাহিকার বাংলাদেশ ও ভারতে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা করে পরিবেশবাদীরা বলেছেন, এতে পানি সংকেটর পাশাপাশি এসব দেশে সামাজিক সমস্যা দেখা দেবে।
বেনারনিউজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রেডিও ফ্রি এশিয়াকে এসব আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তাঁরা।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তিব্বতে অবস্থিত ইয়ারলং সাংপো নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে বলে জানিয়েছে দলটির মুখপত্র চায়না ডেইলির সহযোগী প্রকাশনা চায়না এনার্জি নিউজ।
চীন সরকারের ২০২১-২৫ সালের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ইয়ারলং সাংপোতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উল্লেখ আছে।
চীনা রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ কোম্পানি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন চেয়ারম্যান ইয়ান ঝিয়ং জানিয়েছেন, প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৬০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে চীন। তিনি মনে করেন, এই বাঁধ নির্মাণ করে ‘পরিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ’ উৎপাদনের মাধ্যমে চীনের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর একটি ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিতর্কিত ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধের তিনগুণ বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যাবে।
ভারতের ধর্মশালা ভিত্তিক তিব্বত পলিসি ইনস্টিটিউটের পরিবেশ বিশ্লেষক জামলা তেনপা জ্ঞ্যালস্টেন রেডিও ফ্রি-এশিয়াকে বলেন, “জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীতে ক্রমাগত বাঁধ নির্মাণ চলতে থাকলে ভূমিকম্প ও ভূমিধ্বস হবে, নদীর উজানে জমি ও বন পানিতে তলিয়ে যাবে এবং বন্যপ্রাণীরা হুমকির মধ্যে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা।”
তিনি বলেন, “এর ফলে হয় বন্যা দেখা দেবে নতুবা পানি সংকট দেখা দেবে। তবে মোদ্দা কথা হলো, এর ফলে পরিবেশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে।”
জামলা বলেন, “এই প্রকল্প ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও আসামকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
এদিকে চীনের ওই প্রস্তাবিত বাঁধের বিস্তারিত এখনও জানা যায়নি বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্লেষক-সংগঠন স্টিমসন সেন্টারের দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কর্মসূচি পরিচালক ব্রায়ান ইলার।
তিনি বলেন, “ব্রহ্মপু্ত্রের উজানে বাঁধ নির্মাণ করা হলে তা ভাটি এলাকার মৌসুমী জলচক্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ফলে স্থানীয় ও জাতীয় সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
ব্রায়ানের মতে, “এই নতুন বাঁধ নির্মাণে সিদ্ধান্ত নিতে নিম্ন অববাহিকার দেশগুলোর সাথে খুব সামান্যই আলোচনা করেছে তারা। আর নিম্ন অববাহিকার দেশগুলোর সাথে এটি চীনের নতুন কোনো আচরণ নয়।”
নজিরবিহীন নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা
ব্রায়ান বলেন, ব্রহ্মপু্ত্র, মেকং, ইয়াংসি ও ইয়োলো নদীর উজানে ব্যাপকভাবে বাঁধ নির্মাণ করছে চীন। ইয়ারলং সাংপো প্রকল্প সেগুলোর একটি। এই বাঁধ প্রকল্পগুলোর ফলে নিম্ন অববাহিকায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন চেয়ারম্যান ইয়ান বলেন, এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে তিব্বতের উন্নয়ন ঘটবে। আর আন্তঃদেশীয় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা ও সড়ক নির্মাণের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে।
কিন্তু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বিরোধীরা বলছেন, চীনের প্রায় সবগুলো নদীর সর্বোচ্চ ব্যবহার সীমায় পৌঁছে গেছে। কারণ চীনে ইয়াংসি ও তার শাখা নদীতে থ্রি গর্জেস প্রকল্পসহ আরও বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
জামলা তেনপা বলেন, “এসব সড়ক ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পেছনে চীনা সরকারের মূল উদ্দেশ্য হলো তিব্বতে চীনাদের পূনর্বাসিত করা।”
এ বছরের শুরুতে মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী, মেকং নদীর উজানে নির্মিত বাঁধের কারণে ভাটির দেশগুলোতে খরা সমস্যা প্রকট হয়েছে। তবে চীনা সরকার এই সমীক্ষাকে অগ্রহণযোগ্য আখ্যায়িত করে জানিয়েছে, এই প্রকল্পগুলো থেকে আরো ৩৫০ গিগাওয়াট জলবিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
ভারতের নতুন দিল্লি ভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের গবেষক মনোহর পাররিকার বলেছেন, চীন উজানে যেসব কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে খুব সামান্য তথ্যই মিলছে।
তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, এটি প্রকৃতই ভারতের দীর্ঘমেয়াদী মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আদর্শিকভাবে ভারত আশা করে, এই বাঁধ নির্মাণের আগে চীন ভারতের সাথে আলোচনা করবে।”

বাংলাদেশের জীবনমরণ সমস্যা
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি বিজ্ঞান শাখার সাবেক প্রধান শওকত আলী বেনারকে বলেন, “ব্রহ্মপুত্র আমাদের মূল নদী। বাংলাদেশে যে পরিমাণ পানি আসে তার শতকরা ৬৫ ভাগ পানি আসে এই নদী দিয়ে। সুতরাং, এই নদীর পানি যদি ডাইভার্ট করা হয় তাহলে আমাদের জন্য জীবনমরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।”
তিনি বলেন, “চীনা ড্যাম নির্মাণ করলে তাদের দেখাদেখি ভারতও তাদের অংশে ড্যাম নির্মাণ করবে, হয়তো পানি উত্তোলন করবে। তখন আমাদের অংশে পানি আসার অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।”
শওকত আলী বলেন, “সরকারের উচিত, চীন সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ব্রহ্মপু্ত্র থেকে পানি যাতে প্রত্যাহার করা না হয় সেব্যপারে নিশ্চয়তা আদায় করা।”
পরিবেশবিদ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বেনারকে বলেন, “ষাটের দশকে চীনের পরিকল্পনা ছিল ব্রহ্মপুত্র নদকে অর্থাৎ ইয়ারলং সাংপোকে তারা উত্তর দিকে, অর্থাৎ ইনার মঙ্গোলিয়ার দিকে সরিয়ে নিয়ে যাবে। তারা সেই পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে কি না সে ব্যাপারে আমরা জানি না। প্রকৃতপক্ষে চীন কী করছে সেব্যাপারে খুব কম তথ্যই আমাদের কাছে আছে।”
চীন যদি “শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন করে” তাহলে ভাটির দেশগুলোর কোনো অসুবিধা হবে না” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কারণ বিদ্যু উৎপাদনের জন্য টার্বাইন ঘোরাতে পানি ছাড়তেই হবে।”
“কিন্তু চীন যদি শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের মধ্যে না থেকে পানি সরিয়ে নেয় তাহলে আমাদের বিপদ আছে, বলেন ড. আইনুন নিশাত।
তিনি বলেন, “শুধু চীন নয়, ভারতও ব্রহ্মপুত্রের বিভিন্ন স্থানে ড্যাম নির্মাণ করেছে।”
তাঁর মতে, “বাংলাদেশ ও ভারতের উচিত যৌথভাবে চীনের সাথে কাজ করে নিম্ন অববাহিকায় পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করা।”
চীন-দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বস্ততা তলানিতে
মনোহর পাররিকার বলেন, এই প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে বিনিময় করতে হবে।
তাঁর মতে, “এই তথ্য কৃষি ও জনগণের জীবন জীবিকার উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
চীনের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বস্ততা এখন “তলানিতে” মন্তব্য করে ইস্টওয়েস্ট ইনস্টিটিউটের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কর্মসূচির পরিচালক ফারওয়া আমের বলেন, “অবিশ্বাসের কারণে অনেক কিছুই হচ্ছে না।”
তাঁর মতে, এক দেশ কিছু করলে অন্য দেশ সেটিকে হুমকি হিসাবে বিবেচনা করে।
“নদীকে কৌশলের মাধ্যম হিসাবে বিবেচনা করছে চীন। তবে সেটি আগামীতে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে,” বলেন ফারওয়া আমের।
মেকং নদীর ভাটির দেশগুলোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ব্রায়ান বলেন, “ভাটি অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের বিপরীতে মেকং অববাহিকার তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা এখনও নগণ্য।”
তিনি বলেন, “মেকং নদীতে বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে নিম্ন অববাহিকার দেশগুলোর সাথে চীন আলোচনা করে না বললেই চলে। এ প্রসঙ্গে কোনো তথ্য প্রকাশ না করেই চীনের ইউনান প্রদেশে মেকং নদীর উপরে তৌবা বাঁধ নির্মাণের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।”
লোয়ি ইনস্টিটিউটের হিসাবে, তিব্বত পেল্টু ও চীন শাসিত জিনজিয়াং ও ইনার মঙ্গোলিয়া দিয়ে বছরে ৭১৮ কিউবিক মিটার পানি প্রবাহিত হয়, যার ৪৮ ভাগ প্রবাহিত হয় ভারতের মধ্যে দিয়ে।
প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন রেডিও ফ্রি এশিয়ার মান্দারিন সার্ভিসের জেন ট্যাং, ঢাকা থেকে সহায়তা করেছেন কামরান রেজা চৌধুরী।