৩ বছরের প্রকল্প ৯ বছরে শেষ করল চীনা কোম্পানি

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.02.29
ঢাকা
৩ বছরের প্রকল্প ৯ বছরে শেষ করল চীনা কোম্পানি মহেশখালীর গভীর সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহের জন্য বঙ্গোপসাগরে নির্মিত ভাসমান সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং পয়েন্ট(এসপিএম) । ১০ জুলাই ২০২৩।
[মিনহাজ উদ্দিন/বেনারনিউজ]

সাগরের তলদেশ দিয়ে নির্মিত পাইপলাইন প্রকল্প বা সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম)- এর মাধ্যমে এবার মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংক থেকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পাইপলাইনে তেল সরবরাহ শুরু করল চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরো।
গত ডিসেম্বরে গভীর সমুদ্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংকে তেল নেওয়া হয়েছিল।
এসপিএম প্রকল্পটি তিন বছর পরে ২০১৮ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময় লাগলো নয় বছর। এই সময় চারবার মেয়াদ ও খরচ বাড়ানো হয়েছে।
প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল চার হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা (প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার)। সেই অর্থ বেড়ে গত নভেম্বরে দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২২২ কোটি টাকা, যা ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, ঋণ ছাড়ে চীনের বিলম্ব ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে কাজে বিলম্ব হয়েছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান বেনারকে বলেন, “আজ বৃহস্পতিবার থেকে এসপিএম ব্যবহার করে জ্বালানি তেল আমাদের রিফাইনারিতে নেওয়া শুরু হয়েছে।”
তিনি বলেন, “এই প্রকল্পের আওতায় সাগরের তলদেশ দিয়ে দুটি পাইপলাইন বসানো হয়েছে। প্রতিটি পাইপের দৈর্ঘ্য ১১০ কিলোমিটার। এই পাইপ দুটির মাধ্যমে মহেশখালীর কুতুবদিয়া চ্যানেলে অবস্থানকারী বড় বড় জাহাজ থেকে তেল সরাসরি রিফাইনারিতে আনা হবে।”
মো. লোকমান বলেন, “এখন থেকে মাদার ওয়েল ট্যাংকার থেকে লাইটারেজ জাহাজে করে রিফাইনারিতে আনতে হবে না। ফলে জ্বালানি রিফাইনারিতে আনতে সময় অনেক কমে আসবে, খরচও কমবে।”
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরে প্রায় ২৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলেও জানান তিনি।
প্রকল্প বাস্তবায়নে তিন বছর সময় লাগার কথা, নয় বছর কেন লাগলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই প্রকল্পে অর্থ দিয়েছে চীন। চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে অর্থ পেতে প্রায় তিন বছর সময় লেগেছে। তাছাড়া, এটি খুব জটিল কাজ। শুষ্ক মৌসুমে কাজ করতে হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে সাগর উত্তাল থাকে, ফলে দেরি হয়েছে।”
গত বছরের জুলাই মাসে এসপিএম প্রকল্পটি ব্যবহার করে জ্বালানি সরবরাহ শুরু করা হলেও ত্রুটির কারণে পাঁচ ঘণ্টা পর বন্ধ হয়ে যায়। সেই ত্রুটি মেরামতে বাড়তি অর্থ দিতে হয়।
কেন বাড়তি অর্থ দেওয়া হলো জানতে চাইলে লোকমান বলেন, “প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ঠিকাদার কিছু বাড়তি কাজ করেছে, সে কারণেই তাদের বাড়তি অর্থ দেওয়া হয়েছে।”

চার দফায় বেড়েছে প্রকল্পের সময় ও ব্যয়
প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বর প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে চীনের এক্সিম ব্যাংক ও বাংলাদেশে সরকার। তবে চুক্তিটি কার্যকর হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে।
এই ঋণের বিপরীতে সুদের হার শতকরা দুই শতাংশ এবং প্রতিশ্রুতি ফি শূন্য দশমিক দুই অর্থাৎ শতকরা দুই দশমিক দুই শতাংশ। গ্রেস পিরিয়ড পাঁচ বছর। ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ঋণের সুদ দিতে হবে না। পুরো ঋণ পরিশোধের সময় ধরা হয় ২০ বছর।
চীনের শর্ত অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মে মাস থেকে সুদসহ ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে, যদিও প্রকল্পের সুফল পেতে শুরু করেনি বাংলাদেশ।
তবে বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরোর মূল চুক্তি সই হয় ২০১৫ সালে। প্রকল্পটি ৩৬ মাসের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। সেই অনুসারে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা।
প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের ৭ ডিসেম্বর চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ব্যুরোর সঙ্গে বাস্তবায়ন চুক্তি (ইপিসি) স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন।
তবে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কেবলমাত্র প্রাথমিক জরিপ শেষ করতে পারে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। সে সময় প্রথমবারের মতো প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। ব্যয় বাড়িয়ে পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়, সেই সঙ্গে ব্যয় বেড়ে হয় ছয় হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা।
তৃতীয়বারের মতো মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। খরচ ধরা হয় সাত হাজার ১২৫ কোটি টাকা।
গত বছরের জুলাই মাসে পরীক্ষামূলকভাবে তেল পরিবহন শুরুর পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ায় সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সর্বশেষ নভেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। খরচ বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ২২ কোটি টাকায়।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ তত্ত্বাবধায়ক সাবেক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এসপিএম প্রকল্প একটি ভালো প্রকল্প—সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এটি কাজে লাগানো গেলে দেশের জন্য ভালো হবে কিন্তু এটি যেভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি বলেন, “একটি প্রকল্প কোনো কারণে ছয় মাস বিলম্বিত হতে পারে কিন্তু তিন বছরের প্রকল্প নয় বছরে বাস্তবায়িত হলে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তামিম বলেন, “প্রকল্প বিলম্বিত করা কিছু কিছু কোম্পানির একটি কৌশল বলা যেতে পারে। চীনা কোম্পানিগুলো এই কাজ করে। কাজ পাওয়ার জন্য দরপত্র দাখিল করার সময় কম দর উল্লেখ করে, এরপর কাজ পাওয়ার পরে মাঝ রাস্তায় এসে বলে কাজ করব না। তখন সরকার বিপদে পড়ে যায়। অনেকটা বাধ্য হয়েই খরচ বাড়াতে হয়।”
তিনি বলেন, “বড় প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। সে কারণে ঠিকাদার ও তৃতীয়পক্ষের ওপর নির্ভর করতে হয়। ফলাফল, প্রকল্প বারবার সংশোধন, সময় ও খরচ বৃদ্ধি। এর দায়ভার আসে জনগণের ওপর। এছাড়া, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দুর্নীতি তো আছেই।”
এই সমস্যা কাটাতে তৃতীয়পক্ষের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করার পরামর্শ দেন তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, “বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ও খরচ বৃদ্ধি একটি ‘পুরাতন জটিল রোগ’ বলা যায়।
“এই প্রকল্পটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে আমরা অনেক উপকৃত হতে পারতাম। এই বাড়তি খরচ ঠেকাতে ও প্রকল্প সময় মতো বাস্তবায়ন করতে চীনাদের সঙ্গে আমাদের সঠিকভাবে সমঝোতা করা উচিত ছিল। কারণ প্রকল্প আমাদের, আমাদের স্বার্থ আমাদেরই রক্ষা করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।