সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের কারণ এখনো অজানা
2022.06.06
ঢাকা

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের কারণ কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হতে পারেনি। ঘটনার প্রায় ৫০ ঘণ্টা পার হলেও এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি ভয়াবহ ওই আগুন।
শনিবার রাত সাড়ে নয়টার পর থেকে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সোমবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক পদার্থের চারটি কন্টেইনার শনাক্ত করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ফলে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ছাড়া অন্য রাসায়নিক পদার্থের বিস্ফোরণ ঘটে। কারণ হাইড্রোজেন পারক্সাইড নিজেই বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে না, তবে আগুনের সংস্পর্শে এসে এটি আগুনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এদিকে, ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রোববার প্রকাশিত হতাহতের পরিসংখ্যান সংশোধন করেছে কর্তৃপক্ষ।
কিছু মরদেহ ভুলবশত দুবার গণনা করায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে সোমবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, “এখন পর্যন্ত ৪১ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। তাই মৃতের প্রকৃত সংখ্যা নয়জন ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ মোট ৪১।”
“আমরা ডিপো থেকে রাসায়নিকের চারটি পাত্র শনাক্ত করেছি। ওগুলো নিরাপদ স্থানে সরানো হয়েছে,” বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দলের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন।
তিনি বলেন, পাত্রে রাসায়নিক চিহ্নিত করা ছিল।
আরিফুল বলেন, “প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি, আরও চারটি কনটেইনারে রাসায়নিক রয়েছে। যেসব কনটেইনারে ধোঁয়া ও আগুন দেখা যাচ্ছে, তা বন্ধের চেষ্টা চলছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর বাকি কাজ করা হবে।”
কী ধরনের রাসায়নিকের কারণে ডিপোর শ্রমিকরা মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানান এই কর্মকর্তা।
রাসায়নিক থাকার তথ্য গোপন করার অভিযোগ
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক থাকার তথ্য ডিপো মালিকরা গোপন করেছেন।
“ডিপোর ভিতরে রাসায়নিক আছে এমন তথ্য আমাদের দেওয়া হয়নি। আমরা যদি রাসায়নিকের বিষয়ে আগেভাগে জানতাম, আমাদের উদ্ধার অভিযানের পদ্ধতি ভিন্ন হতো,” বেনারকে বলেন সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ইনচার্জ মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।
তিনি বলেন, “আমাদের কাছে যা মনে হয়েছিল তাহলো; আগুন লাগার পর বিস্ফোরণ ঘটে। মোট কতগুলো বিস্ফোরণ ঘটেছে, তা আমরা নিশ্চিত নই।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক এস এম মিজানুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, হাইড্রোজেন পারক্সাইড কোনো দাহ্য রাসায়নিক নয় এবং বিস্ফোরণের জন্য একে দায়ী করা উচিত নয়।
একা হাইড্রোজেন পারক্সাইড খুব কমই কোনো বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, তবে এটি যদি আগুনের সংস্পর্শে আসে তবে আগুনকে আরও বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম।
বিস্ফোরক বিভাগের প্রধান এবং অগ্নিনির্বাপক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডিপোতে হাইড্রোজেন পারক্সাইডের বিশাল মজুদ ছিল যা বিভিন্ন শিল্প কাজে ব্যবহৃত হয়।
হাইড্রোজেন পারক্সাইডের পোড়া ও বিস্ফোরিত নীল প্লাস্টিকের কন্টেইনার কন্টেইনার ডিপোর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বলে জানান তাঁরা।
“ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকতে হবে। কিন্তু আমরা কনটেইনার ডিপোতে কোনো ফায়ার হাইড্রেন্ট দেখতে পাইনি,” বেনারকে বলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক মোঃ দুলাল মিয়া।
সন্ধ্যা ৬.১৩ মিনিটে (স্থানীয় সময়) তিনি বেনারকে জানান, আগুন পুরোপুরি নেভাতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। তবে তীব্রতা কমে এসেছে।

তদন্ত শেষে হলে জানা যাবে কী ঘটেছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সোমবার বিএম কন্টেইনার পরিদর্শন করেন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন।
“দমকল কর্মীরা আগুন নেভানোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। আগুনের তীব্রতা কমে এসেছে,” সন্ধ্যা ৭টায় বেনারকে বলেন মন্ত্রী।
“আমি শুনেছি কনটেইনার ডিপোতে রাসায়নিক থাকার তথ্য মালিক গোপন করেছেন। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আমাকে এখনো এরকম কিছু বলেনি,” যোগ করেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, “দুটি সরকারি দপ্তর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। তদন্ত প্রতিবেদন শেষ হওয়ার পর সেখানে কী ঘটেছে তা আমরা জানতে পারব।”
এর আগে সোমবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের দেখতে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কারো গাফলতি থাকলে ছাড় দেয়া হবে না এবং আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
কনটেইনার ডিপোর মালিককে গ্রেপ্তারের দাবি
সোমবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে 'নিরপেক্ষ কমিশন' গঠনের দাবি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ফখরুল বলেন, “আমি মনে করি যে, এ ঘটনার জন্য অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা উচিত। এর জন্য যারা দায়ী তাদের খুঁজে বের করা দরকার।”
একইসঙ্গে এ ঘটনায় হতাহতদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ এবং দেশের সকল কনটেইনার ডিপোতে 'তদারকি ব্যবস্থা' চালু করার দাবিও জানান বিএনপি মহাসচিব।
এদিকে জাতীয় সংসদে বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা সোমবার অভিযোগ করেছেন, ডিপোর মালিকপক্ষ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা বলেই নিয়ম না মেনে ডিপোতে রাসায়নিক রেখেছেন।
ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছে পুলিশ
সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বেনারকে বলেন, “প্রতিটি পরিবারের দুজনের কাছ থেকে নমুনা নেয়া হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে নিখোঁজদের পরিবারের কাছে তাঁদের স্বজনদের লাশ পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হবে।”
কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুন-বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত-নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিচয় শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করেছে পুলিশের সিআইডি ফরেনসিক বিভাগ।
সোমবার সকাল সড়ে নয়টা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে।
তিনি জানান, সর্বমোট ৪১টি মরদেহের মধ্যে ২০টি তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, বাকি ২১টি লাশ চেনা যায় না বলে স্বজনদের খোঁজ করছেন এমন ৩৭জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো: ইলিয়াস চৌধুরী বেনারকে বলেন, গুরুতর আহত শতাধিক ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কয়েকজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।”
তিন মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের সামনে অপেক্ষা করছিলেন ১৯ বছর বয়সী রেশমী বেগম।
রেশমীর স্বামী ট্রাক ড্রাইভার মো: শাহজাহান অগ্নিকাণ্ডের সময় বিএম কনটেইনার ডিপোতে ছিলেন।
“ঘটনার পর থেকে আমি আমার স্বামীর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না,” সাংবাদিকদের বলেন রেশমী।