প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইনে প্রবাসীদের আপত্তি
2017.01.20

দেশে এবং বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সমালোচনার মুখে প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব আইন জাতীয় সংসদে পাঠানোর আগে প্রবাসীদের মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণীত এই আইনের খসড়ায় অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। খসড়াটি ভেটিংয়ের জন্য এখন আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।
আইন মন্ত্রী বলেছেন, আইনটি চূড়ান্ত করার আগে বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের সুবিধা-অসুবিধা পর্যালোচনা করা হবে। তিনি বলেন, “অনাবাসী বাংলাদেশিদের সুবিধা-অসুবিধা জানতে চেয়ে শিগগিরই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।”
আইনটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “নতুন আইনে দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগে বাংলাদেশিদের জন্য কেবল আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের দ্বৈত নাগরিক হওয়ার সুযোগ ছিল।”
প্রবাসীদের ব্যাপক আপত্তি
দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে প্রস্তাবিত আইনের ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক অন্য দেশের নাগরিকত্ব লাভ করলে তিনি দ্বৈত নাগরিক হিসেবে বিবেচ্য হবেন। এ জন্য ওই ব্যক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য আবার আবেদন করতে হবে।
এই বিধানের ফলে ওই প্রবাসী ব্যক্তির নাগরিকত্বের সিদ্ধান্তটি সময়সাপেক্ষ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কবলে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন প্রবাসীরা।
আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হইবেন যদি তার পিতা-মাতা এ আইন বলবৎ হইবার তারিখে বা উহার পরে অথবা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে এই আইন বলবৎ হইবার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হন বা থাকেন।’
কয়েক দশক ধরে সুইডেনে বসবাস করছেন বাংলাদেশের একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান শেখ তসলিমা মুন। বেনারকে তিনি বলেন, “অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না নিয়ে লন্ডন-আমেরিকায় চলে গেছেন। যদি এ আইন পাস হয়, তাহলে তাদের এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের কী হবে?”
খসড়া আইন অনুযায়ী, সন্তান জন্মের দুই বছরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস বা মিশনের কার্যালয়ে নাম নিবন্ধন করতে হবে। অন্যথায় ওই সন্তান জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক বলে বিবেচিত হবে না।
দ্বৈত নাগরিকেরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, সংসদ সদস্য, বিচারপতি এমনকি স্থানীয় কোনো নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তারা বাংলাদেশ সরকারের কোনো চাকরি করতে পারবেন না। এতে উদ্বিগ্ন হয়েছেন বিদেশে অবস্থানকারীদের অনেকেই।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ব্যারিস্টার নজরুল খসরু সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার মতে প্রস্তাবিত দ্বৈত নাগরিকত্ব আইন প্রবাসী স্বার্থ বিরোধী।
তিনি বেনারকে বলেন, “নতুন আইন আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের পর তৃতীয় প্রজন্মের সন্তানদের বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া কঠিন করে দেবে। জন্মসূত্রে আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ায় আমাদের সন্তানরা নাগরিকত্ব পেলেও যেহেতু জন্মসূত্রে তারা বাংলাদেশের নাগরিক নন, সেহেতু তাদের সন্তানদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়া কঠিন হবে।”
প্রবাসে সমর্থকও আছে
তবে প্রস্তাবিত আইনের এসব বিধানকে সমর্থন করেছেন কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক সওগত আলী সাগর। বেনার নিউজকে তিনি বলেছেন, “ভিন্ন দেশের প্রতি আনুগত্য নিয়ে কারও বাংলাদেশে নির্বাচন করা বা সাংবিধানিক পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ থাকা উচিত না। এটি নৈতিকও না।”
আইনটির বিষয়ে তার অভিমত জানতে চাইলে এক ই–মেইল বার্তায় তিনি বলেন, “সার্কভুক্ত দেশ এবং মিয়ানমার ছাড়া অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব নিলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যাবে—এমন কথা প্রস্তাবিত আইনের কোথাও বলা হয়নি।”
প্রতিবেশী দেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব নয়
নতুন আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো বাংলাদেশি সার্কভুক্ত দেশ বা মিয়ানমারের দ্বৈত নাগরিকত্ব নিতে পারবে না। কেউ বৈবাহিক সূত্রে এসব দেশের কোনোটির নাগরিক হলে তাদের এক দেশের নাগরিকত্ব ছাড়তে হবে।
এ ছাড়া সরকার গেজেট জারি করে যেসব দেশকে নাগরিকত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, সেসব দেশেরও দ্বৈত নাগরিক হওয়া চলবে না। এর বাইরে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে এমন যে কোনো রাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিকত্ব বাংলাদেশিরা এই আইনের ফলে নিতে পারবে।
সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান| আবার ২৮ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রকে তার নাগরিকের জন্মস্থান অনুযায়ী বিবেচনা করা থেকে বিরত রেখেছে।”
তার মতে প্রস্তাবিত আইনটি চূড়ান্ত হলে তা হবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।