জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উৎপাদন ক্ষমতা কমছে পোশাক শ্রমিকদের

রিয়াদ হোসেন
2024.03.06
ঢাকা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উৎপাদন ক্ষমতা কমছে পোশাক শ্রমিকদের ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারী কর্মীরা। ১৮ ডিসেম্বর ২০২৩।
[মো. হাসান/বেনারনিউজ]

রাজধানীর মিরপুর এলাকার একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন নাজমা আক্তার। ছয় মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলায় নিজের গ্রামে চলে গেছেন।

বেনারের সঙ্গে আলাপকালে দুই সন্তানের মা নাজমা জানান, “কারখানাটির প্রতিটি তলায় মাত্র একটি করে এক্সস্ট ফ্যান ছিল। অত্যধিক গরমে কাজ করে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। দুই-তিনটা খাওয়ার স্যালাইন কিনে নিয়ে যেতাম বাসাও ছিল গরম, রাতে ঘুম হতো না। এ কারণে মাঝে মাঝে কাজে যেতে দেরি হতো।

“তিন দিন দেরি হলে এক দিনের হাজিরা কেটে রাখতো, আবার স্যাররা খারাপ ব্যবহারও করতেন। এসব কারণে চাকরি ছেড়ে এখন গ্রামে চলে এসেছি,” বলেন তিনি।

কেবল নাজমা আক্তার নন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং আরও অন্যান্য কারণে কারখানায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পোশাক শ্রমিকের উৎপাদন ক্ষমতা কমে গেছে। যাদের হাত ধরে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় আসে।

শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণায় উঠে এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রায় অর্ধেক শ্রমিকের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অসুস্থতাজনিত ছুটি বা অনুপস্থিত থাকা, উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তাদের আয় কমে গেছে।

অত্যধিক খরা, তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকা, ঘন ঘন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে নির্দিষ্ট সময়ে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা, মৌসুম শুরু ও শেষ হওয়ার সময় পরিবর্তনের নানা ধরনের অসুখ পোশাক শ্রমিকদের প্রতিবন্ধকতা হয়েছে দাঁড়িয়েছে—উঠে এসেছে গবেষণায়।

বুধবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বিলস এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক মনিরুল ইসলাম।

গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “অর্ধেক পোশাক শ্রমিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভুগছেন। ফলে ছুটি বা কারখানায় অনুপস্থিতি বেড়েছে প্রায় এক-চতুর্থাংশ, দক্ষতা কমেছে শতকরা আট শতাংশ, উৎপাদন কমেছে ছয় শতাংশ, সেই সঙ্গে আয় হ্রাস ও চাকরির নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে শতকরা ১৩ শতাংশ।”

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তৈরি পোশাক কারখানার ভেতরে তাপ বেড়েছে বলে মনে করেন প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক বলে উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

মনিরুল ইসলাম বেনারকে জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর অদূরে গাজীপুরের ১৬০টি তৈরি পোশাক কারখানার চার শতাধিক শ্রমিকের ওপর জরিপ চালিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। জার্মানিভিত্তিক সংস্থা জিআইজেডের সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

এছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি শ্রমিক স্থানান্তরিত হয়েছেন বলেও উঠে এসেছে গবেষণায়।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যার বেশির ভাগই নারী।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৩৬ শতাংশ শ্রমিক স্থানান্তরিত হয়েছেন। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, ফসলের উৎপাদন হ্রাস, কীটপতঙ্গের আক্রমণ বৃদ্ধি, উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়াকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নদী ভাঙনের কারণে স্থানান্তরিত হয়েছেন সাত শতাংশ মানুষ।

এছাড়া প্রতিবেদনে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পরিবেশ রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপের বিষয়টি উঠে এসেছে। স্থানীয় সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তর, মালিকপক্ষ ও বেসরকারি উদ্যোগেও পরিবেশগত বিষয়টি সমাধান হয়নি বলে মনে করেন অর্ধেকের বেশি শ্রমিক।

দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিকের ভাষ্য, সরকারের নীতি-নির্ধারণে তাদের মতামত বা অংশগ্রহণ থাকে না।

শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক ড. বিশ্বজিৎ রায় বলেন, “শ্রমিকের অধিকারের বিষয়টি নিয়েই আমাদের বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে যে কর্মক্ষমতা নষ্ট হচ্ছে, তাও এখন বিবেচনায় নেওয়ার সময় এসেছে।”

ক্ষতির দাম দিতে হবে বিদেশি ক্রেতাদের

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয় কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত। পোশাক শ্রমিকদের এই ক্ষতি কমিয়ে আনতে বিদেশি ক্রেতাদের এ জন্য আলাদা করে বাড়তি দর দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম জাকির হোসেন খান বলেন, “বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কি পরিবেশগত বিরূপ প্রভাবের জন্য কোনো বাড়তি দর দিচ্ছে? তারা কেবল পণ্যের দাম দিচ্ছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে, এ জন্য বাড়তি দর নেওয়ার।”

প্রতিটি শার্টে এক ডলার করে নেওয়ার প্রস্তাব রাখেন তিনি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ থেকে একক ব্র্যান্ড হিসেবে সবচেয়ে বেশি পোশাক কেনে সুইডেনভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম।

বিলসের প্রতিবেদন ও এ বিষয়ে এইচঅ্যান্ডএমের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে বেনারের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠানটির স্টকহোম কার্যালয়ে মেইল পাঠানো হয়। জবাবে প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া বিভাগের ইনিগো শেঞ্জ মিস্ত্রে বলেন, “জলবায়ু সংকট সমাধানে আমরা অংশীদার হতে চাই, যার জন্য সময়াবদ্ধ লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। আমরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ক্রমাগত পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও টেকসই পণ্য সরবরাহের পাশাপাশি কার্বন কমাতে বিনিয়োগ করে যাচ্ছি।”

তবে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পোশাক কারখানার শ্রমিকের জন্য বাড়তি দর দেওয়ার প্রসঙ্গে ব্র্যান্ডটি কিছু জানায়নি।

বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনা শীর্ষস্থানীয় একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের ঢাকা অফিসের প্রধান কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক, আমরা এটি আরও বোঝার চেষ্টা করছি।”

তিনি বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সরবরাহ চেইনে কী ধরনের প্রভাব পড়বে, তা আমরা কিছুটা জানি কিন্তু শ্রমিকরা কী ধরনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করবেন, এ ধরনের কোনো গবেষণা নেই।”

পরিবেশবান্ধব কারখানার মালিকরা বাড়তি দর পাচ্ছেন না

বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা গত এক দশক ধরে পরিবেশবান্ধব কারখানায় বিনিয়োগ করলেও ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি দর পাচ্ছেন না।

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশের গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা দুই শতাধিক। মাত্র আট শতাংশ কারখানায় বর্জ্য পরিশোধন করা হয়।

বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০টি পরিবেশবান্ধব কারখানার একটি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ফ্যাশন্স লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে শামীম এহসান বেনারকে বলেন, “আমার কারখানা পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে বাড়তি ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এ জন্য ক্রেতার কাছ থেকে একটি উৎসাহব্যঞ্জক চিঠি ছাড়া বাড়তি কোনো দর বা ক্রয়াদেশ পাইনি।

“যে মাসে পরিবেশবান্ধব সনদ পেলাম, ওই মাসেই বরং বিদেশি এক ক্রেতা পোশাকের দর কমানোর জন্য চাপ দিয়েছেন। এই অবস্থা কেবল আমাদের কারখানার ক্ষেত্রে নয়, প্রায় সবার ক্ষেত্রেই,” যোগ করেন তিনি।

বাড়তি ক্রয়াদেশ বা দর না পেলে পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তুলতে ও বজায় রাখতে উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হবেন বলেও মনে করেন পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর এই নেতা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।