পশ্চিমবঙ্গে বাড়ছে সাম্প্রদায়িক অশান্তি

কলকাতা থেকে পরিতোষ পাল
2017.01.17
হাওড়ার ধুলাগড়ে হামলাকারীদের আক্রমণে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি। হাওড়ার ধুলাগড়ে হামলাকারীদের আক্রমণে বিধ্বস্ত একটি বাড়ি। ফাইল চিত্র।
বেনার নিউজ

ভারতজুড়ে প্রবল সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময়েও শান্ত রাজ্য হিসেবে পরিচিত ছিল পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু সেই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। গত কয়েক মাসে পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িক অশান্তির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে।

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অনুগামী মানবাধিকার সংস্থা হিন্দু সংহতির তথ্য হচ্ছে, গত পুজো ও মহরমের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের ৮টি জেলার অন্তত ১২টি জায়গায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে। এসব খবর ও ছবি মূল ধারার সংবাদপত্রে তেমন প্রকাশিত না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দুই গোষ্ঠীর অনুগামীরাই বিষয়টি নিয়ে ঝড় তুলছেন।

সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত ১২ ডিসেম্বর কলকাতা থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে হাওড়া জেলার ধুলাগড় নামে জায়গায়। নবীর জন্মদিন উপলক্ষে মিছিল করা নিয়ে বচসা থেকে উত্তেজনা চরমে উঠেছিল। দুই দিন পরে সেই উত্তেজনা হিংসাত্মক রূপ নেয়। বোমাবাজি থেকে শুরু করে অস্ত্র নিয়ে হামলার পরিণতিতে অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছে। অনেক বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে, লুট হয়েছে টাকা পয়সা, সোনার গয়না।

পুলিশ প্রশাসন পরিস্থিতি সামাল দিতে পদক্ষেপ নিয়েছে। এসপিকে বদলি করা হয়েছে। তবে সেখানকার পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ঘটনাস্থলে যেতে গিয়ে বার বার পুলিশের বাধায় ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। বিজেপির একটি কেন্দ্রীয় টিম ঘটনাস্থলে যেতে বাধা পেয়ে রাস্তা অবরোধেও শামিল হয়েছিল।

ধূলঅগড়ে যেতে না দেবার প্রতিবাদে বিজেপির পথ অবরোধ। ১৯ ডিসেম্বর.২০১৬।
ধূলঅগড়ে যেতে না দেবার প্রতিবাদে বিজেপির পথ অবরোধ। ১৯ ডিসেম্বর.২০১৬।
বেনার নিউজ
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ জাহির সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক চুপ করে বসে নেই। আমরা ধুলাগড়ের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি।”

ধুলাগড় ছাড়াও মালদহের কালিয়াচক, নদীয়ার জুরানপুর, বর্ধমানের কাটোয়া, হুগলির চুঁচুড়া-চন্দন নগরেও সামান্য বিরোধের ঘটনা দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে।

কলকাতার এই সময় পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। কেন বারবার রাজ্যের বিভিন্ন অংশে একই রকমের উত্তেজক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক উদ্যোগী হয়েছে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, গোটা পরিস্থিতিতে বিশেষ কোনো মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাত রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে।

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল সুরজিৎ পুরকায়স্থের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার দপ্তর থেকে বেনারকে জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে তিনি কোনো কথা বলবেন না।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অবশ্য রাজ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক অশান্তির কথা কখনো মানেন নি। তিনি বরং স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, সামান্য দুচারটে গোলমাল হলেও পশ্চিমবঙ্গে কোনো রকম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নেই। তবে ঘটনাস্থলে রাজনৈতিক দলগুলোকেও যেমন যেতে দেওয়া হচ্ছে না তেমনি মিডিয়ার প্রবেশও আটকানো হয়েছে।

জনপ্রিয় জি নিউজ চ্যানেলে ধুলাগড়ের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার চ্যানেলের সম্পাদকসহ তিন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করেছে। জি নিউজ চ্যানেলের সম্পাদক সুধীর চৌধুরি ফেসবুকে এই মামলা দায়েরের খবর জানিয়ে লিখেছেন, অস্বস্তিকর তথ্য ও বাস্তব পরিস্থিতি গোপন রাখতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার পুলিশকে ব্যবহার করে মিডিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এই ঘটনাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অসহিষ্ণুতার একটি উদাহরণ বলে তিনি জানিয়েছেন।

ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআইএম) অভিযোগ করেছে, ভারতীয় জনতা পার্টি ও তৃণমূল কংগ্রেস হাতে হাত মিলিয়ে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করছে। সিপিআইএমের পলিটব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম বেনার নিউজকে জানিয়েছেন, “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চক্রান্ত চলছে। পুলিশ প্রশাসন আগে থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব। কিন্তু পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুপ করে থাকছে।”

“ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অপরাধীদের আড়াল করতে একে তাকে ধরা হচ্ছে,” অভিযোগ সেলিমের।

ভারতীয় জনতা পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সিদ্ধার্থ নাথ সিং অভিযোগ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের যেখানে যেখানে বিজেপির শক্তি বাড়ছে সেই সব জায়গাতেই তৃণমূল কংগ্রেসের গুন্ডারা সাম্প্রদায়িক অশান্তি তৈরি করছে।

“সমাজবিরোধীদের সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের যে আঁতাত তৈরি হয়েছে তার ফলে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ফলে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে” বেনারকে জানান সিদ্ধার্থ সিং।

উত্তর ২৪ পরগণা জেলার চটকল অধ্যুষিত হাজিনগরে গত কয়েক বছরে একাধিকবার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা গিয়েছে। তবে সেখানকার ভারতীয় জনতা পার্টির কাউন্সিলর রবি শংকর সিং বেনার নিউজকে জানিয়েছেন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার জন্য দুই গোষ্ঠীই সমানভাবে দায়ী। এটা অবশ্য তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে তিনি জানিয়েছেন।

“পুলিশ প্রশাসনের কাছে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণের আরজি জানানো সত্ত্বেও পুলিশ ওপর মহলের চাপে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতি পরবর্তী সময়ে ভয়ংকর আকার নিয়েছে,” অভিযোগ করেন রবি শংকর।

পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হচ্ছে বলে জানিয়ে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী কিরীটী রায় বেনার নিউজকে বলেছেন, “প্রশাসন উপযুক্ত সময়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় দুই গোষ্ঠীর মধ্যকার মৌলবাদী গোষ্ঠী সুযোগ পেলেই পরিস্থিতিকে ঘোরালো করে তুলছে। তাঁর মতে, রাজনৈতিক মেরুকরণের রাজনীতিও এর পেছনে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

“রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। আর এই কাজে সমাজবিরোধীদের ব্যবহার করছে দুই গোষ্ঠীই,” বেনারকে জানান ভাষা ও চেতনা সমিতির সম্পাদক অধ্যাপক ইমানুল হক।

তাঁর মতে, ভোটের দিকে তাকিয়ে সুস্পষ্ট ধর্মীয় মেরুকরণের জন্যই সাম্প্রদায়িক অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে দুই সম্প্রদায়ের মৌলবাদী অংশের মধ্যে আতাঁতও রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।