করোনাভাইরাস: ভোগান্তিতে প্রান্তিক পর্যায়ের গর্ভবতী নারীরা

জেসমিন পাপড়ি
2021.01.07
ঢাকা
করোনাভাইরাস: ভোগান্তিতে প্রান্তিক পর্যায়ের গর্ভবতী নারীরা দুই মাস বয়সী সন্তান জুবায়েরকে কোলে নিয়ে বাড়ির সামনে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শৈলখালী গ্রামের জান্নাতুন খাতুন। করোনার কারণে গর্ভকালে একবারও ডাক্তার দেখাতে পারেননি তিনি। ৩১ ডিসেম্বর ২০২০।
[জেসমিন পাপড়ি/বেনারনিউজ]

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল কৈখালীর ইসমত আরা (২২) তৃতীয়বারের মতো মা হয়েছেন মাত্র কয়েকদিন আগে। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় বিনা চিকিৎসা ও উৎকণ্ঠায় কেটেছে তাঁর পুরো সন্তানধারণ কাল।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালের কোথাও দরকারি চিকিৎসা না পেয়ে প্রসব নিয়ে বেশ ঝুঁকিতে পড়তে হয় তাঁকে।

“প্রায় ১০-১২ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে শ্যামনগর উপজেলা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানকার ডাক্তাররা করোনা আক্রান্ত ছিলেন। বাধ্য হয়ে কয়েকটি ক্লিনিকে গেলাম। সেখানেও ডাক্তার দেখাতে পারিনি,” গর্ভধারণের আট মাস চলাকালে বেনারকে বলেন ইসমত আরা।

পা ফোলা, পেটে ব্যথাসহ তাঁর নানা ধরনের সমস্যা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “ডাক্তার দেখাতে না পেরে ক্লিনিকের লোকজনের পরামর্শে কয়েকটি টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট একজন ডাক্তারকে দেখাতে সক্ষম হই।”

নভেম্বরে প্রসবের জন্য কয়েকটি ক্লিনিকে গেলেও তখন তাঁর সর্দি-কাশি থাকায় কেউ তাঁকে ভর্তি করেনি বলে জানান ইসমত আরা। ফলে বাড়িতে দাইয়ের তত্ত্বাবধানে সন্তান জন্ম দিতে হয় তাঁকে।

“চাইছিলাম হাসপাতালে ডেলিভারিটা হোক। কিন্তু পারিনি,” মন্তব্য করে ইসমত আরা জানান, “জন্মের পরপরই বাচ্চা নীল হয়ে যাচ্ছিল।”

পরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নবজাতককে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করানোর পর “বাচ্চাটা সুস্থ হয়ে ফিরেছে,” জানান ইসমত আরা।

দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার বাসিন্দা তাসলিমা খাতুন (২০) বেনারকে জানান, মহামারিকালে নদী পারাপারসহ প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শ্যামনগর সদরে তিনবার ডাক্তারের কাছে গেছেন তিনি। এর মধ্যে মাত্র একবার একটি ক্লিনিকে ডাক্তার দেখাতে পেরেছেন।

“বাকি দুইবার ফেরত আসতে হয় বিনা চিকিৎসায়। সে সময় করোনা আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালেও ডাক্তার ছিলেন না,” বলেন তাসলিমা খাতুন।

তাসলিমা জানান, প্রথমবার মা হয়েছেন। চেয়েছিলেন হাসপাতালে প্রসব করাতে, “কিন্তু সর্দি-কাশি থাকায় কেউ ভর্তি নেয়নি।”

করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হতে তাঁর কোনো সমস্যা হতো না, কিন্তু শ্যামনগরে সেই সুযোগ সহজলভ্য নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “ভাবতাম, কী নির্মম ভাগ্য আমার ও আমার সন্তানের! একজন ডাক্তারও কপালে জোটে না।”

তাসলিমার সন্তানেরও জন্ম হয়েছে গ্রামের ধাত্রীর হাতে। এই ধাত্রী কখনো কোনো প্রশিক্ষণ পাননি। ধাত্রীর হাতে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে তাঁর যোনিপথ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শ্যামনগর উপজেলার শৈলখালী গ্রামের জান্নাতুন খাতুনও (১৭) করোনার কারণে গর্ভকালে ডাক্তার দেখাতে পারেননি। তবে প্রসবকালে অবস্থার অবনতি হওয়ায় শ্যামনগর সদর হাসপাতালে গিয়ে সিজার করে শিশুর জন্ম দেন। জন্মের পরপরই শিশুটির অক্সিজেন সাপোর্টের দরকার হয় বলে জানান তিনি।

চিকিৎসা না পাওয়া দুঃখজনক

মহামারিকালে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেশিরভাগ গর্ভবতীর অবস্থাই তাসলিমা, জান্নাতুন বা ইসমত আরার মতো। সরেজমিনে দেখা যায়, করোনাভাইরাস আতঙ্কে হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা পাচ্ছেন না তাঁরা।

শহরাঞ্চলে করোনা পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও প্রত্যন্ত এলাকায় সেই সুবিধা পৌঁছায়নি। ফলে অন্যান্য চিকিৎসাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিষয়টি স্বীকার করে সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ হুসাইন শাফায়াত বেনারকে বলেন, “আমাদের জেলা শহরে কোনো পিসিআর ল্যাব নেই।”

তিনি জানান, শ্যামনগর থেকে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য নমুনা প্রথমে ৭০ কিলোমিটার দূরে জেলা শহরে পাঠাতে হয়। সেখান থেকে সেই নমুনা আরো ৭০ কিলোমিটার দূরে যশোর কিংবা ৬০ কিলোমিটার দূরে খুলনাতে যায়।

যশোর বা খুলনা থেকে রিপোর্ট পেতে তিন থেকে পাঁচ দিন লেগে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, “এতে করে রোগীর চিকিৎসা দিতে দেরি হয়ে যায়।”

এছাড়া সরকার করোনা পরীক্ষার জন্য ১০০ টাকা ফি নির্ধারণ করায় অনেক দরিদ্র মানুষ লক্ষণ থাকলেও পরীক্ষা করাতে চান না বলে জানান তিনি। তাঁর মতে, অন্তত প্রান্তিক পর্যায়ে এই পরীক্ষা বিনামূল্য থাকা উচিত ছিল। কারণ “এই মহামারিকালে একশ’ টাকাও তাঁদের কাছে অনেক।”

তবে সরকার ভেবে চিন্তেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করেছে বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুল মান্নান।

“বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন পরিস্থিতিতে নেই যে একজন মানুষ একশ টাকা পরীক্ষা ফি দিতে পারবে না,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “একেবারে ফ্রি হলে মানুষ অল্পতেই বারবার পরীক্ষা করাতে আসবে। তাতে বিশৃঙ্খলা বাড়বে। বিশৃঙ্খলা এড়াতেই নামমাত্র ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।”

এদিকে “শুরুর দিকে হাসপাতালগুলোতে যে পরিস্থিতি ছিল, তা এখন নেই। যদিও এখনো অনেক রোগী হাসপাতালে আসতে ভয় পান,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

“তবে হাসপাতালে আসার পরেও চিকিৎসা না পাওয়া দুঃখজনক। অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো,” জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “দেশের সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিককে সব ধরনের রোগীর, বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে।”

একই ধরনের মন্তব্য করেন সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন। তিনি বলেন, রোগী যাওয়ার পরেও যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক চিকিৎসা দেয়নি প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

“কাউকে চিকিৎসা না দেওয়ার সুযোগ নেই। কোনো রোগী করোনার লক্ষণ থাকলে প্রয়োজনে আইসোলেশনে রেখে তাকে চিকিৎসা দিতে হবে,” বলেন সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ হুসাইন শাফায়াত।

প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি কমেছে

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে সর্বশেষ উপজেলা শ্যামনগরের কয়েকটি বেসরকারি ক্লিনিক থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আগের তুলনায় করোনাভাইরাস মহামারিকালে এসব ক্লিনিকে সেবার হার কমে অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে।

শ্যামনগরের নগর প্রাইভেট হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, এই ক্লিনিকটিতে ২০১৯ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত পাঁচ মাসে যেখানে ১৭২ গর্ভবতী নারী ভর্তি হয়েছিলেন; সেখানে করোনাকালে ২০২০ সালের একই সময়ে ভর্তি হয়েছেন মাত্র ৫৭ জন নারী।

একই উপজেলার সুন্দরবন নার্সিং হোমের তথ্যানুযায়ী, ওই হাসপাতালে মহামারিকালে ২০২০ সালের মার্চ-জুলাই পাঁচ মাসে মাত্র ৪৩ জন নারীর প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি হয়েছে। যেখানে ২০১৯ সালের একই সময়ে হাসপাতালটিতে সন্তান জন্ম দেন ১১৫ জন নারী। 

করোনার ভয়ে রোগীদের হাসপাতালে আসার সংখ্যা কমে যাবার পাশাপাশি যাদের সর্দি-কাশির মতো করোনা উপসর্গ আছে তাঁদেরকে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না বলে বেনারকে জানান শ্যামনগরের নগর প্রাইভেট হাসপাতালের ম্যানেজার আবুল খায়ের।

“কারণ, তারা করোনা আক্রান্ত কি না সেটা আমাদের নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই। ফলে বাধ্য হাসপাতালে থাকা বাকি রোগী এবং ডাক্তার-নার্সদের নিরাপত্তার কথা ভেবে নিরুপায় হয়ে রোগীদের ফেরত পাঠাই,” বলেন তিনি।

গত পাঁচ মাসে অন্তত ১২টি ডেলিভারি করিয়েছেন জানিয়ে কৈখালী ইউনিয়নের শৈলখালী গ্রামের ধাত্রী লায়লা বেগম বেনারকে বলেন, “অন্যসময় এত বেশি ডেলিভারি আর গ্রামে হয় না। সবাই হাসপাতালে ডেলিভারি পছন্দ করে।”

অনভিজ্ঞ দাইয়ের হাতে প্রসব “মা ও শিশুর মৃত্যুরও কারণ হতে পারে,” বলে মনে করেন কুমুদিনী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বিলকিস বেগম চৌধুরী।

“হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো থেকে যাতে কোনো রোগী ফেরত পাঠানো না হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন “করোনার পরীক্ষার সুযোগ সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। এই পরীক্ষা সবার জন্য ফ্রি করা উচিত।”

তবে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মহামারিকালেও রোগীর পরিমাণ খুব একটা কমেনি।

উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন পরিষদ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০১৯ সালের মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট তিন হাজার ৩০ জন নারীর প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি হয়। ২০২০ সালের একই সময়ে মহামারিকালে ডেলিভারির সংখ্যা কমেছে মাত্র ১৪০টি।

গ্রামে পৌঁছায়নি করোনা পরীক্ষা

সাতক্ষীরায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত বছরের ২৬ এপ্রিল। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলার জনসংখ্যা সাড়ে ১৯ লাখের বেশি।

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সাতক্ষীরা থেকে মাত্র ৬ হাজারের কিছু বেশি মানুষের করোনা টেস্টের নমুনা পাঠানো হয়েছে, যাদের মধ্যে আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ১৫৬ জন।

শীত বাড়ার সাথে সাথে এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় সর্দি কাশি, যা করোনার অন্যতম লক্ষণ- সেটার প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে বলে বেনারকে জানান শ্যামনগর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার সোরা গ্রামের কমিউনিটি ক্লিনিকের হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার হেলেনা বিলকিস।

কিন্তু সুযোগ না থাকায় “এই গ্রামে এখন পর্যন্ত কারো করোনাভাইরাস পরীক্ষা করা হয়নি,” জানিয়ে তিনি বলেন, “ফলে কেউ করোনা আক্রান্ত কি না সেটা বোঝার উপায় নেই।”

এই সময়ে অন্যান্য রোগীদের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে গর্ভবতী নারীদেরও চিকিৎসা পেতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান হেলেনা বিলকিস।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ লাখ ১৯ হাজার ৯০৫ জন, মৃত্যু হয়েছে সাত হাজার ৭১৮ জনের। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট করোনাভাইরাস পরীক্ষাগারের সংখ্যা ১৮১টি।

সারা দেশে পরীক্ষাগারের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্যসচিব।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন আট কোটি ৭৬ লাখ ৫৪ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ১৮ লাখ ৯১ হাজারের বেশি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।