বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, শুরু হচ্ছে বিধিনিষেধ
2022.01.12
ঢাকা

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক বেড়ে একদিনে প্রায় তিন হাজার রোগী শনাক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার থেকে সারা দেশে ১১ দফা বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা আগেই জানানো হয়েছিল।
গত কয়েকদিনে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভার্চু্য়ালি এক অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যাতে দ্রুত ছড়াতে না পারে, সেজন্য কিছু বিধি-নিষেধ দেওয়া হয়েছে। এগুলো মেনে চলবেন।”
বাস-ট্রেন-লঞ্চে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলা, উন্মুক্ত স্থানে যে কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বন্ধ করাসহ সোমবার ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এতে বলা হয়, রেস্তোরাঁয় বসে খেতে এবং আবাসিক হোটেলে থাকতে টিকা সনদ দেখাতে হবে। ১২ বছরের বেশি বয়সের শিক্ষার্থীদের টিকা সনদ ছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আবারও অর্ধেক আসন খালি রেখে শনিবার থেকে বাস চললেও এবার ভাড়া বাড়ছে না। বুধবার বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠকে বাস মালিকেরা ভাড়া এই দফায় ভাড়া না বাড়াতে রাজি হয়েছে।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ২ হাজার ৯১৬ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে; যা আগের দিনের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি। এই নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ১৬ লাখ এক হাজার ৩০৫ জনে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া গত একদিনে আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে; এই নিয়ে করোনায় ২৮ হাজার ১১১ জনের প্রাণ গেলো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হিসাব অনুযায়ী, নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
এদিকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টারে তিন জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন অমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে দুই জন ভারতীয় ও একজন বাংলাদেশি নাগরিক।
বুধবার যবিপ্রবির জিনোম সেন্টারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে করোনার নতুন এ ধরনটি শনাক্ত করেন বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এই নিয়ে দেশে অমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩৩ জনে। তবে বুধবার দেশে অমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (সামাজিক সংক্রমণ) শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ করোনা রোগীই ওমিক্রনে আক্রান্ত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শঙ্কিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী
দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্তের হার বেড়ে যাওয়ায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দেশের হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
বুধবার ঢাকায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এইসব রোগীদের একটি অংশ চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যাবে। এখনই সতর্ক না হলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে, সেক্ষেত্রে হাসপাতালে জায়গা দিতে সমস্যা হবে।
“যারা আক্রান্ত হচ্ছেন আমরা ধরে নিই, তাদের পাঁচ শতাংশের যদি হাসপাতালে আসতে হয় তাহলে আগামী পাঁচ-সাতদিনের মধ্যেই অনেক রোগী হয়ে যাবে।”
“তখন আবার একটা কষ্টকর অবস্থা তৈরি হবে। হাসপাতালে প্রেশার পড়বে, চিকিৎসক-নার্সদের ওপর প্রেশার পড়বে। সিট পেতে সমস্যা হবে, মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে,” বলেন তিনি।
উচ্চ ঝুঁকিতে ঢাকা ও রাঙ্গামাটি
শনাক্তের হার বিবেচনায় রাজধানী ঢাকা ও পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী ছয় জেলা মাঝারি মাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় সারাদেশকে লাল, হলুদ ও সবুজ-এই তিন ভাগে ভাগ করেছে। লাল রঙকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ, হলুদকে মধ্যম এবং সবুজ কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, উচ্চ ঝুঁকির এলাকা ঢাকা ও রাঙ্গামাটি জেলায় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ১০ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশের মধ্যে। মধ্যম মাত্রার ঝুঁকিতে অর্থাৎ হলুদ জোনে রয়েছে রাজশাহী, রংপুর, নাটোর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, যশোর। এসব জেলায় শনাক্তের হার এখন ৫ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে।
এ ছাড়া শূন্য থেকে চার শতাংশের মধ্যে সংক্রমণের হার রয়েছে এমন ৫৪টি জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে সবুজ জোনে।
লক ডাউন চান না ব্যবসায়ীরা
দেশে আবার করোনাভাইরাস শনাক্তের হার বাড়তে থাকলেও লকডাউনের মতো কঠোর সিদ্ধান্ত না দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “পৃথিবীতে এখন কোনো দেশ লকডাউন দিচ্ছে না। কারণ লকডাউনের কারণে ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। গত বছর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কারণে আমাদের রপ্তানি বাড়ছে।”
“করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও আমরা জিডিপির ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে,” বলেন তিনি।
এর আগে ২০২০ সালে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু হলে মার্চের শেষ দিকে দেশজুড়ে লকডাউন দেয়া হয়, যা চলে দুই মাসের বেশি সময় ধরে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে লক ডাউন তুলে নেওয়া হয়।
ধীরে ধীরে সংক্রমণের হার আরো কমে এলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়। জীবনযাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। এরই মাঝে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করেছে।
নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আবার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা লকডাউন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বলে জানান এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন।
গতবারের লকডাউনের কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে এখনও ১৫ শতাংশ শ্রমিক সংকটে রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “গত বছর ১৩ থেকে ১৪ দিন পোশাক কারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা চাকরি ছেড়ে বাড়ি গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সুতরাং লকডাউনই সমাধান নয়, এর কারণে ক্ষতি হচ্ছে।”
তার বদলে স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপর জোর দেয়ার আহবান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি।