করোনাভাইরাস: সংক্রমণ সহনীয় পর্যায়ে, রোববার টিকাদান শুরু
2021.02.05
ঢাকা

গত আট মাসের মধ্যে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই প্রেক্ষাপটেই ৩৫ লাখ মানুষকে টিকা দেবার লক্ষ্য নিয়ে রোববার থেকে শুরু হচ্ছে দেশব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ১৯ জানুয়ারি থেকে সংক্রমণের হার পরীক্ষাকৃত নমুনার শতকরা পাঁচ ভাগের কম পাওয়া যাচ্ছে, যা শুক্রবার নেমে এসেছে শতকরা তিন ভাগের নিচে।
সংক্রমণের হার টানা তিন সপ্তাহ পরীক্ষিত নমুনার শতকরা পাঁচ ভাগের নিচে থাকলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে কোনো মহামারিকে সহনীয় পর্যায়ে গণ্য করা হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে টিকা দেয়া শুরু হবে বলে ঢাকায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
টিকা নেবার জন্য সরকারি অ্যাপের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেড় লাখের বেশি মানুষ নাম নিবন্ধন করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের হাতে থাকা ৭০ লাখ টিকা দিয়ে জনপ্রতি দুটি হিসেবে ৩৫ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া যাবে।
প্রসঙ্গত, সরকারের হাতে থাকা টিকাগুলোর মধ্যে ২০ লাখ এসেছে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে, বাকি ৫০ লাখ বেক্সিমকোর মাধ্যমে ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকা।
চুক্তিমতে, প্রতি মাসে পাঁচ লাখ করে জুনের মধ্যে আরো ২৫ লাখ টিকা আসবে সিরাম ইন্সটিটিউট থেকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশে বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক হলেও করোনাভাইরাস যে চলে গেছে তা ভাবা যাবে না। যে কোনো সময় পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তাই টিকা নেবার বিকল্প নেই।
“বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে কোনো দেশে শতকরা পাঁচ ভাগের নিচে সংক্রমণ চলে আসলে সেদেশের অবস্থাকে গ্রহণযোগ্য বলা হয়,” বলে বেনারকে জানান সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ. এস. এম আলমগীর।
তাঁর মতে, বাংলাদেশের মহামারি পরিস্থিতি ‘আশাব্যঞ্জক’ হলেও “এই ভাইরাস চলে গেছে বলা যাবে না। আমাদের টিকা নিতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।”
একই রকম মত প্রকাশ করে আইইডিসিআর-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক আহমেদ বেনারকে বলেন, বর্তমানে সংক্রমণ “অনেক কম” হলেও “এই সংক্রমণ যে চলে যাবে তেমন বলা যায় না।”
“ভবিষ্যতে যে আরেকটি ওয়েভ আসবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং, আমাদের টিকা নিতে হবে,” বলেন তিনি।
করোনাভাইরাস টিকার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে ধীরে ধীরে আগ্রহ বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এই আগ্রহ বৃদ্ধি করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে টিকা সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচার বন্ধ করতে হবে।”
“সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও টিকা সম্পর্কে নেতিবাচক গুজব ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ,” বলেন মোশতাক আহমেদ।
সংক্রমণের হার নিচে নেমে আসাকে বিবেচনায় নিয়ে করোনাভাইরাস বাংলাদেশ থেকে চলে গেছে বা বা সহসাই চলে যাবে তা ভাবা উচিত হবে না বলে মনে করেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক।
তাঁর মতে, বাংলাদেশে দৈনিক কম সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা হয়, এটাও কম সংখ্যক সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার কারণ হতে পারে।
“আমাদের দেশে যে হারে পরীক্ষা করা হয় তা প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না। যদি দিনে ১০ থেকে ১৫ হাজারের পরিবর্তে ৫০ হাজার পরীক্ষা করা যেত তাহলে প্রকৃত চিত্র বোঝা যেত,” বেনারকে বলেন রুহুল হক।
‘টিকা নিতে চাই, তবে একটু পরে’
রাজশাহী শহরের বাসিন্দা সৈয়দ টুটুল বেনারকে বলেন, “আসলে টিকা নেয়া উচিত। আমি টিকা নিতে চাই, তবে একটু পরে। এটি একটি নতুন টিকা। আমি আসলে দেখতে চাই যারা টিকা দিচ্ছেন তাঁদের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কিনা।”
আইইডিসিআর কর্মকর্তা আলমগীরের মতে, “এ পর্যন্ত যতগুলো করোনাভাইরাস টিকা এসেছে তার মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্র্যাজেনেকার টিকা সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ।”
বর্তমানে সংক্রমণের হার কম হলেও দেশের প্রত্যেকটি নাগরিককে এই টিকা নিতে হবে। না হলে এই সংক্রমণ বাংলাদেশ থেকে নির্মূল হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, “সবাই যদি পরে নিতে চায় তাহলে কেমন করে হবে?”
এদিকে টিকা দেয়ার জন্য অ্যাপের মাধ্যমে নাম নিবন্ধনের প্রক্রিয়া সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য নয় বলে মন্তব্য করেন রুহুল হক।
“বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের পক্ষে অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করা সহজ নয়,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, “যদি জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে টিকা নেয়ার ব্যবস্থা করা হতো তাহলে সাধারণ মানুষ সহজেই টিকা নিতে পারতেন।”
তবে টিকা নেবার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে যাদের অসুবিধা হচ্ছে তাঁদেরকে স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সহায়তা করবেন বলে সম্প্রতি গণমাধ্যমে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. নাসিমা সুলতানা।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয় গত বছরের ৮ মার্চ। করোনাভাইরাসে প্রথম রোগীর মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। এরপর থেকে ধীরে ধীরে সংক্রমণ বেড়ে জুন-জুলাই মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।
সরকারি হিসাবে, ২ জুলাই একদিনে সর্বোচ্চ চার হাজার ১৯ জন রোগী শনাক্ত হন। এই রোগে ৩০ জুন একদিনে সর্বোচ্চ ৬৪ জন মানুষ মারা যান।
এরপর ধীরে ধীরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিমাণ কমতে থাকে। যার ধারাবাহিকতায় শুক্রবার আক্রান্তের সংখ্যা ৪৩৫ ও মৃত্যুর সংখ্যা নেমে এসেছে সাত জনে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ লাখ ৩৭ হাজার ৪৬৫ জন, মৃত্যু হয়েছে আট হাজার ১৮২ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন দশ কোটি ৫২ লাখ ২৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন ২২ লাখ ৯৩ হাজারের বেশি।