করোনাভাইরাস: টিকা কিনতে সরকারের খরচ ২০ হাজার কোটি টাকা

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.02.07
ঢাকা
করোনাভাইরাস: টিকা কিনতে সরকারের খরচ ২০ হাজার কোটি টাকা ঢাকার কড়াইল বস্তির একটি কেন্দ্রে করোনাভাইরাস টিকা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি করোনাভাইরাসের গণটিকা কার্যক্রম শুরুর পর থেকে টিকা কিনতে সরকার কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান মন্ত্রী, যদিও এর আগে জাতীয় সংসদে তিনি এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দেননি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের অধিকাংশ টিকাই চীন থেকে কেনা এবং এর কোনো হিসাব সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।

এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে টিকা কেনার খরচ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করা হলো। তবে কোন দেশে থেকে কত টাকায় এবং কত সংখ্যক টিকা কেনা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু জানাননি মন্ত্রী।

টিকার পেছনে খরচ করা এই টাকার পরিমাণ বেশি না যুক্তিসঙ্গত, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা সরাসরি মতামত দিতে চাননি।

টিকা কিনতে গত এক বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচের ব্যাপারে “প্রশ্ন করতে চাই না,” মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সোমবার বেনারকে বলেন, “টাকার দিকে তাকালে আমরা টিকা ক্রয় করতে পারতাম না। টিকা সংগ্রহ করা একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল।”

তবে সরকার প্রতিশ্রতিমতো “এপ্রিলের মধ্যে সকলকে টিকার আওতায় আনতে পারবে কি না,” সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমরা যা দেখছি তাতে টিকা দেওয়ার হার সন্তোষজনক বলা যায় না।”

“টিকা দেয়ার ব্যবস্থাপনা আরো উন্নত করা যেত। শুধু ব্যবস্থাপনা ভালো হলেই টিকা দেয়ার হার বৃদ্ধি করা যেত,” বলেন অধ্যাপক নজরুল।

প্রথম ডোজে জোর দেয়া হচ্ছে

“বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে আমাদের প্রায় ১২ কোটি অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে,” বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস.এম. আলমগীর।

রোববার পর্যন্ত দেশের ছয় কোটি ৫১ লাখের বেশি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ এবং ১০ কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। এছাড়া এখন পর্যন্ত বুস্টার ডোজ পেয়েছেন প্রায় ২০ লাখ মানুষ।

তিনি বলেন, “আমরা ইচ্ছা করলেও কিন্তু দ্বিতীয় ডোজ দেয়া দ্রুত করতে পারি না। কারণ প্রথম ডোজের পর কমপক্ষে ২৮ দিন অপেক্ষা করতে হবে। সেকারণে আমরা প্রথম ডোজ দেয়ার ওপর জোর দিচ্ছি।”

বর্তমানে দেশে ১১ কোটি টিকা মজুদ রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “চীন থেকে আমরা টিকা ক্রয় করেছি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কোভ্যাক্সের মাধ্যমে দুই কোটি ২০ লাখ ফাইজারের টিকা অনুদান হিসাবে পেয়েছি।”

“দুই মাসের মধ্যে আরো ছয় কোটি ৩০ লাখ টিকা যুক্তরাষ্ট্র ও কোভ্যাক্সের মাধ্যমে আমরা পাব,” বলেন ড. আলমগীর।

এদিকে টিকা না পাওয়ার কারণে গত বছরের মাঝামাঝি দেশে “টিকা দেয়ার হার কমে যায়,” বলে বেনারকে জানান সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন।

টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের “একটি বিরাট কাঠামো রয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) মাধ্যমে প্রতি বছর কোটি কোটি টিকা দেওয়া হয়।

“সেই কাঠামো ব্যবহার করায় টিকা দেয়ার খরচ খুব বেশি হয়নি,” বলেন মোশতাক হোসেন।

গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে পাওয়া অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দিয়ে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশ। তবে তিন কোটি টিকা দেয়ার চুক্তি থাকলেও ৭০ লাখ টিকা দেয়ার পর টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সেরাম ইন্সটিটিউট।

পরে চীনে উৎপাদিত সিনোফার্ম টিকা দিয়ে টিকা কার্যক্রম চালু রাখে সরকার। সিনোফার্মের টিকার দাম প্রকাশ করায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব শাহিদা আকতারকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। এরপর থেকে আর কখনও চীন থেকে কেনা টিকার দাম জানানো হয়নি।

৫০ ভাগের বেশি চীনা টিকা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, রোববার পর্যন্ত প্রথম ডোজ হিসেবে চীনের তৈরি সিনোফার্ম টিকা পেয়েছেন পাঁচ কোটির বেশি মানুষ এবং সিনোভ্যাক টিকা পেয়েছেন প্রায় ৭২ লাখ মানুষ। অর্থাৎ প্রথম ডোজ টিকা প্রাপ্তদের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি চীনা টিকা।

দ্বিতীয় ডোজ প্রাপ্তদের মধ্যে প্রায় চার কোটি ৫৯ লাখ সিনোফার্ম এবং নয় লাখ সিনোভ্যাক টিকা নিয়েছেন।

এ ছাড়া, প্রথম ডোজ হিসাবে অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রায় দুই কোটি, ফাইজার-বায়ো এনটেক প্রায় এক কোটি ৭৫ লাখ এবং মডার্নার ৩২ লাখের বেশি টিকা দেয়া হয়েছে।

দ্বিতীয় ডোজ হিসাবে এক কোটির বেশি মানুষ অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ৫১ লাখের বেশি ফাইজার-বায়ো এনটেক এবং প্রায় ২৭ লাখ মডার্নার টিকা নিয়েছেন।

হিসাব দিতে হবে

বিরোধী দল বিএনপির সাংসদ মোঃ হারুনুর রশীদ সোমবার বেনারকে বলেন, সরকার করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে কত টাকা খরচ করছে, তা জানতে আমরা সংসদের গত দুই অধিবেশনে লিখিত প্রশ্ন করেছি। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেই হিসাব দেননি। বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ দাম প্রকাশ করতে পারে না।

তিনি বলেন, “আমাদের কথা হলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অর্থ বরাদ্দ করেছে এই সংসদ। সেই টাকা কীভাবে খরচ করা হচ্ছে সেব্যাপারে সংসদকে বিস্তারিত জানাতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই হিসাব দিতে বাধ্য।”

হারুনুর রশীদ বলেন, “আজকে প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানালেন যে টিকা কিনতে গত এক বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে বললে চলবে না। আমরা আগামী অধিবেশনে টিকা কেনার হিসাব চাইব।”

তিনি বলেন, দেশে যত টিকা এসেছে সেগুলোর সব কিন্তু কেনা নয়। একটি বড়ো অংশ জাতিসংঘ, আমেরিকা, জাপান, ভারত, চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে উপহার হিসাবে বাংলাদেশে এসেছে। মন্ত্রীকে পরিষ্কারভাবে বলতে হবে, কোন দেশ থেকে কত টিকা অনুদান হিসাবে এসেছে এবং কত টিকা টাকা দিয়ে কেনা হয়েছে।

একদিনে ৩৮ মৃত্যু

দেশে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ধরনের বিস্তারের মধ্যে একদিনে আরও ৩৮ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা ২০ সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এক দিনে এর চেয়ে বেশি মৃত্যুর খবর এসেছিল সর্বশেষ গতবছরের ১৯ সেপ্টেম্বর, সেদিন ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সাড়ে ৪৪ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করে নয় হাজার ৩৬৯ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে।

নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত কোভিড রোগীর সংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৯০১ জন। তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ৬২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।