বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, নমুনার বিপরীতে আক্রান্ত প্রায় নয় শতাংশ

জেসমিন পাপড়ি
2021.03.16
ঢাকা
বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, নমুনার বিপরীতে আক্রান্ত প্রায় নয় শতাংশ দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলেও স্বাস্থ্যবিধি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গুলিস্তানের ফুটপাতে কেনাকাটার দৃশ্য। ১৬ মার্চ ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের হার আবারও উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত থাকতে বলেছে স্বাস্থ্যবিভাগ। চলমান পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ খুলে না দেবার পক্ষেই মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা, তবে এই মুহূর্তে লকডাউন ঘোষণার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে দেশে সংক্রমণের হার পরীক্ষিত নমুনার তিন শতাংশের নিচে নামলেও মার্চের শুরু থেকে তা বাড়তে বাড়তে এখন নয় শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে। 

গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ২৬ জন মারা গেছেন এবং এক হাজার ৭১৯ জন নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন বলে মঙ্গলবার জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই নিয়ে দেশে মোট করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৮৭ জন এবং মোট মৃতের সংখ্যা ৮ হাজার ৫৯৭ জন।

এর আগে গত সোমবারও ২৬ জনের মৃত্যু এবং এক হাজার ৭৭৬ জন রোগী শনাক্তের কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবার সাংবাদিকদের জানান, করোনার সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষাপটে দেশের সব হাসপাতালকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশের সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কঠোর ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢামেক) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বেনারকে বলেন, “করোনার কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।”

“দেশের অন্যতম বড়ো হাসপাতাল ঢামেকে সব সময় রোগীর চাপ থাকে। সম্প্রতি কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী বাড়লেও তা আমাদের সক্ষমতার বাইরে যায়নি। তবে কোথাও কোনো গ্যাপ থাকলে তা ঠিক করে নেয়ার চেষ্টা করছি,” বলেন তিনি। 

অসতর্কতাই প্রকোপ বাড়ার কারণ

সরকার ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্যবিধি শিথিল হওয়ার কারণেই দেশে আবারও করোনার প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে।

“করোনা কমে আসায় বিপুল সংখ্যক লোক অসতর্ক হয়ে ওঠে। কেউ কেউ এক ডোজ টিকা নিয়ে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। প্রচুর জনসমাগম হচ্ছে। ফলে আবারও অতি-সংক্রমণ শুরু হয়েছে,” বেনারকে বলেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এম এইচ চৌধুরী লেলিন।

তিনি বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকার করোনার ধরনও বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের সামনে বড়ো বিপর্যয় আসতে পারে, যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মানি।”

তাঁর মতে, স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য নতুন করে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নামানোর পাশাপাশি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নতুন উদ্যোমে ব্যাপক প্রচারাভিযান শুরু করতে হবে। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “অন্তত আগামী দুই সপ্তাহ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়তে থাকলে অবশ্যই স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত আরও পরে নিতে হবে। একই সাথে মানুষের সমাগম ঘটে এমন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক, ধর্মীয় কার্যক্রমকে এখন স্থগিত করা উচিত।” 

তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আবার বাড়লেও নতুন করে লকডাউন দেওয়ার চিন্তা নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম। 

মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে এক বৈঠকের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ফিরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার ওপর। এজন্য প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্য নিতে আমাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।” 

মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “লকডাউনের বিষয়ে আমাদের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তবে আগের যে স্বাস্থ্যবিধি ছিল, সেগুলো বেশি বেশি করে মানা, সেগুলো প্রচার করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।” 

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর প্রকোপ বাড়তে শুরু করলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মার্চের শেষ দিকে লকডাউনের বিধিনিষেধ শুরু হয়। 

টানা ৬৬ দিন পর গত ৩১ মে থেকে অফিস-আদালত খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। আগস্টে বিনোদন কেন্দ্রও খোলার অনুমতি দেয়।

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে গত জুলাই মাসের শেষ দিকে বাসার বাইরে সব জায়গায় সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে সরকার। এরপর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে মাস্ক না পরার অপরাধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বেশ কিছুদিন। 

করোনার নতুন ধরন বাংলাদেশে

দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের (স্ট্রেইন) অস্তিত্ব বাংলাদেশেও পাওয়া গেছে। করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সের উন্মুক্ত তথ্যভাণ্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিসএআইডি) ওয়েবসাইটে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

যদিও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।

এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে করোনার নতুন যে ধরন পাওয়া গেছে সেটিও জানুয়ারিতে বাংলাদেশে পাওয়া গেছে। জানুয়ারির শুরুর দিকে যুক্তরাজ্য ফেরত যাত্রীদের মধ্য থেকে প্রথম এই ধরন শনাক্ত হয় বলে জানান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন। 

উদাসীনতার অভিযোগ

দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলেও সরকার এ বিষয়ে এখনো উদাসীন বলে অভিযোগ তুলেছে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি।

মঙ্গলবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “করোনাভাইরাস ধরন পরিবর্তন করে আবার আক্রমণ করছে; সারা পৃথিবী ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ সাবধানতা অবলম্বন করেনি।”

“ব্রিটেন লকডাউন করেছে, ভারতে লকডাউন করেছে আবার, ইউরোপ লকডাউন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই। কেননা তাদের সামনে কিছু অনুষ্ঠান আছে,” বলেন তিনি।

বিএনপি নেতা মোশাররফ বলেন, “আমরা মনে করি, সরকার এখনো উদাসীন অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বিতীয় ধাপ বা দ্বিতীয় টেউকে প্রতিরোধে করার জন্য যে কর্মকাণ্ডগুলো করা দরকার, সেগুলোর একটাও করছে না। 

উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে আগামী ১৭ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সরকার। এতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পাঁচটি দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধান অংশ নেবেন। 

এ ছাড়া এক বছর পর আগামী ৩০ মার্চ থেকে দেশের স্কুল–কলেজ এবং ২৪ মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।