বাংলাদেশে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণে
2022.03.23
ঢাকা

দুই বছরে সাড়ে ১৯ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত ও ২৯ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাবার পর অবশেষে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের ৭০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা ও জনগণের ভেতর প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হওয়াই এই সাফল্যের মূল কারণ বলে চিহ্নিত করছেন তাঁরা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, সংক্রমণ আবার বাড়বে না এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, সোমবার থেকে গত ৭২ ঘণ্টায় বুধবারই প্রথম করোনাভাইরাসে একজনের প্রাণহানি ঘটেছে। এক সপ্তাহ ধরে পরীক্ষা করা নমুনার বিপরীতে শনাক্ত হার রয়েছে শতকরা দুই ভাগের নিচে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে নতুন করে মাত্র ৯০৪ জন রোগী সংক্রমিত হয়েছেন এবং ২২ মার্চ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুধবারের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে সোমও মঙ্গলবার দেশে করোনাভাইরাসে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ, এর দশ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম রোগী মারা যান। এই রোগে এ পর্যন্ত দেশে মারা গেছেন ২৯ হাজার ১১৮ জন, মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১৯ লাখ ৫০ হাজার ৯৮০ জন।
টিকা ও হার্ড ইমিউনিটি
সম্প্রতি বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে প্রতিদিন “দু-একজন রোগী মারা যাচ্ছেন। আবার শনাক্তের হারও প্রায় এক শতাংশ,” জানিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যায়।”
এই অর্জনের পেছনে মূল দুটি কারণ চিহ্নিত করে তিনি বলেন, “একটি হলো; ব্যাপক টিকা কার্যক্রম। আরেকটি হলো; হার্ড ইমিউনিটি। আমাদের জনগণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি হয়েছে বলা যায়।”
তবে এখনই “করোনাভাইরাস শেষ হয়ে গেছে—এমন কথা বলে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই,” বলে মনে করেন অধ্যাপক নজরুল।
তাঁর মতে, টিকা দেয়া ও জনগণের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিই এই নিম্নহারের কারণ নাকি “এই ক্রমনিম্নমুখী শনাক্ত হারের সাথে অন্য কোনো কারণ জড়িত রয়েছে,” তা বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন।
“আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের ভাইরাসের আগমন ঘটে। এই ভাইরাসগুলো অনেক সময় অন্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করে। শনাক্ত হার নিম্নমুখী হওয়ার কারণ এটি কি না তাও দেখতে হবে,” বলেন অধ্যাপক নজরুল।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ধরুন আপনার শরীরে আগে থেকেই কোনো মৌসুমি ভাইরাস প্রবেশ করলে সেই ভাইরাস আপনার শরীরে অন্য কোনো ভাইরাসকে প্রবেশ করতে দেবে না। আপনার শরীর থেকে ওই ভাইরাস চলে না যাওয়া পর্যন্ত নতুন কোনো ভাইরাস আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না।”
চলতি মৌসুমে অন্য কোনো ভাইরাসের কারণে করোনার নিম্নহার কি না তা নিশ্চিত হতে তিনিসহ কয়েকজন গবেষণা করছেন জানিয়ে অধ্যাপক নজরুল জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে গবেষণাটি সম্পন্ন হবে।
তবে টিকাই সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে নিম্নমুখী শনাক্ত হার ও কম মৃত্যুর কারণ বলে মনে করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন।
তিনি বেনারকে বলেন, “যেহেতু আমাদের জনসংখ্যার ৭০ ভাগের বেশি মানুষ টিকার আওতায় চলে এসেছেন সেহেতু সংক্রমণ ও মৃত্যু দুই-ই কম।”
মহামারি নিয়ন্ত্রণে সাম্প্রতিক এই অর্জন “ধরে রাখা সম্ভব নাও হতে পারে,” আশঙ্কা প্রকাশ করে ডা. মোশতাক বলেন, বাংলাদেশে যদি করোনাভাইরাসের নতুন কোনো ধরন না আসে এবং অন্তত তিন মাস ধরে এই নিম্নমুখী প্রবণতা থাকে, তাহলে বলা যাবে “করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসলে আরেক দফা সংক্রমণ বাড়বে।”
এছাড়া, “নতুন ভ্যারিয়েন্ট না আসলেও আরেক দফা সংক্রমণ ঢেউয়ের কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না,” বলেও মনে করেন তিনি।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ড. মোশতাক বলেন, “আমরা যেই টিকা নিচ্ছি সেগুলো আমাদের তিন মাস ইমিউনিটি দিচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিন মাস পর ইমিউনিটি আর থাকছে না। সুতরাং, যাদের ইমিউনিটি চলে যাচ্ছে তাঁরা আবার পুরাতন ভ্যারিয়েন্টেই সংক্রমিত হতে পারেন।”
প্রায় শত ভাগ টিকা দেয়ার পরও কেন থাইল্যান্ড, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়ায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “টিকা নিলেই যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না, এটি সবাই জানে। টিকা নিলে মৃত্যু ঝুঁকি কমে যায়, হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা কমে যায়।”
“ওই সব দেশগুলোতে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ বৃদ্ধি করছে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে আমাদের দেশে এবছর শুরুর দিকে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। আমরা ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কিছুদিন পরে ওই সকল দেশেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে,” যোগ করেন ডা. মোশতাক।
রোজার পর শুরু হবে বুস্টার ডোজের প্রচারণা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ১২ কোটি ৬৭ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন, যাদের মধ্যে নয় কোটি ৩২ লাখের বেশি মানুষ দুই ডোজ টিকা নিয়েছেন। বুস্টার ডোজ নিয়েছেন প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ।
“আমরা ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক শতকরা ৭০ ভাগের বেশি অর্থাৎ ১২ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় এনেছি। এই মাসের শেষের মধ্যে এই ৭০ ভাগ মানুষের সবাই দুই ডোজ টিকার আওতায় আসবেন,” বেনারকে জানান সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এস. এম. আলমগীর।
তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য সবাইকে টিকার আওতায় আনা। আমরা গত কয়েক দিনে তিন লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দিয়েছি। মানুষ টিকা কেন্দ্রে আসলেই টিকা পাবেন।”
“রোজার পর বুস্টার ডোজ দেওয়ার জন্য প্রচারণা শুরু করব,” জানিয়ে ড. আলমগীর বলেন, “আমাদের হাতে বর্তমানে আট কোটি বিভিন্ন কোম্পানির টিকা রয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও ছয় কোটি ফাইজার টিকা আসছে।”
ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের হিসাবে ৩ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ছয় কোটি ১০ লাখ টিকা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই টিকার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ফাইজারের টিকা, যা শিশুদের দেওয়া হয়েছে।