ব্র্যাকের জরিপ: করোনাভাইরাসের প্রভাবে বেড়েছে চরম দারিদ্র্য
2020.04.10
ঢাকা

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে আগের তুলনায় চরম দারিদ্র্য অবস্থা বেড়েছে ৬০ শতাংশ। আর খাবার নেই প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
শুক্রবার প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, দেশের ৬৪ জেলার দুই হাজার ৬৭৫ জন নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে পরিচালিত জরিপে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত ৩১ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে জরিপটি চালানো হয়।
এই জরিপের সাথে একমত পোষণ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশের শ্রম বাজারে ছয় কোটি এক লক্ষ লোক রয়েছে। এদের মধ্যে এক কোটি ৪০ লাখ লোক মাসিক ভিত্তিতে বেতন পায়। বাকিদের মধ্যে এক কোটি দিনমজুর। বাকি ২ কোটি ৭০ লক্ষ লোকের রয়েছে স্বকর্মসংস্থান।”
“মাস ভিত্তিতে বেতন পায় না, এমন প্রায় চার কোটি মানুষ দিনমজুরি বা ছোটখাটো ব্যবসা করে জীবন চালায়। এরা যখন কাজ করেছে তখন চরম দারিদ্রে ছিল না। করোনার প্রভাবে এখন আয় বন্ধ হওয়ায় অনেকেই চরম দারিদ্র সীমার নিচে নেমে গেছে,” বলেন তিনি।
অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর বলেন, “এখন সরকারকে অন্তত তাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু রয়েছে তার আওতা বাড়াতে হবে। যারা এই কর্মসূচিতে ছিল না তাদেরও আনতে হবে।”
“শহরাঞ্চলে ওপেন মার্কেট সেল বাড়াতে হবে। এখন এসব অভাবী মানুষেরা খাদ্যের কাছে পৌঁছাতে পারবে না। তাই খাদ্যকে তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এর জন্য সরকারি-বেসকারি সমন্বয়ের মাধ্যমে রেশনিং ব্যবস্থা চালু এবং ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে,” মনে করেন তিনি।
কোভিড-১৯ এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়েছে স্বীকার করলেও সরকার বলছে, দেশের কোনো মানুষ অভুক্ত নেই।
দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মো. এনামুর রহমান বেনারকে বলেন, “খাদ্য সংকট যে আসতে পারে সে বিবেচনা ছুটি ঘোষণার আগেই সরকার করেছে। ফলে এ পর্যন্ত সারা দেশে ৬৫ হাজার নয়শ মেট্রিকটন চাল এবং ২৫ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা এবং শিশু খাদ্যের জন্য তিন কোটি ১৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”
জেলা প্রসাশকের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে নিম্ন আয়, কর্মহীন এমনকি মধ্যবিত্তদের মাঝেও এইসব সহায়তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
ব্র্যাকের জরিপের তথ্য সঠিক নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত এমন কোনো রিপোর্ট পাইনি যে, কারো ঘরে খাদ্য নেই।”
“আগামী তিন মাস পর্যন্ত এভাবে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের আছে,” দাবি করে ডা. এনাম বলেন, “এরপরেও যদি সংকট দেখা যায় তাহলেও তা মোকাবেলা করার মতো সামর্থ্য আমাদের আছে এবং আমরা বিনামূল্যে খাদ্য দিতে পারব।”
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বেনারকে বলেন, “যারা দিন আনে দিন খায় তাদের এখন কোনো কাজ না থাকায় অবশ্যই সংকট আছে। তবে এদের মধ্যে কিছু লোক আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে, অনেকে ১০ টাকা কেজি চাল বিতরণের আওতায় চলে আসবে। যথেষ্ট না হোক এক-দুই বেলা পেট ভরে খাবার মতো সংস্থান আছে বলে আমি মনে করি।”
“তারপরেও স্বীকার করতে হবে, ইনফরমাল সেক্টরে যারা কাজ করত তাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।
“তবে এখন মাঠে বোরো ফসল পাকা অবস্থায় আছে, যা আমাদের অন্যতম প্রধান ফসল। শহরের দিনমজুরি করা মানুষ গ্রামে যাওয়ায় তারা ধান কাটার মৌসুমে যোগ দিতে পারবে,” যোগ করেন পরিকল্পনামন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসমাগম এড়াতে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার, যা তিন দফায় বাড়িয়ে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। এই সময়ে জরুরি সেবায় নিয়োজিত লোকজন ছাড়া বাকি সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘরে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কাজ কমেছে ৭২ শতাংশের
ব্র্যাকের জরিপে বলা হয়, নিম্নআয়ের মানুষের জীবিকায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধের পদক্ষেপের মারাত্মক প্রভাব পড়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ২ হাজার ৬৭৫ জনের করোনা মহামারির আগে গড় মাসিক আয় ছিল ১৪ হাজার ৫৯৯ টাকা। এদের ৯৩ শতাংশই জানিয়েছেন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর এ বছরের মার্চে তাঁদের গড় আয় দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৭৪২ টাকায়।
অর্থাৎ তাঁদের পারিবারিক আয় ৭৫ শতাংশের মতো কমে এসেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম (৮৪ শতাংশ), রংপুর (৮১ শতাংশ) এবং সিলেট বিভাগের (৮০ শতাংশ) মানুষের আয় কমেছে সবচেয়ে বেশি।
সরকারি ছুটি বা সামাজিক দূরত্বের কারণে ৭২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন বা তাঁদের কাজ কমে গেছে। ৮ শতাংশ মানুষের কাজ থাকলেও এখনো তাঁরা বেতন পাননি।
কৃষিকাজে সম্পৃক্তদের (৬৫ শতাংশ) তুলনায় অ-কৃষিখাতের দিনমজুর বেশি (৭৭ শতাংশ) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৫১ শতাংশ রিকশাচালক, ৫৮ শতাংশ কারখানা শ্রমিক, ৬২ শতাংশ দিনমজুর, ৬৬ শতাংশ হোটেল বা রেস্তোরাঁকর্মী জানান, চলতি মাসে তাঁদের আয় নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।
এ ছাড়া ১৪ ভাগ মানুষের ঘরে খাবার নেই। ২৯ শতাংশের ঘরে আছে ১ থেকে ৩ দিনের খাবার।
এই পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে কীভাবে মানিয়ে নিতে হবে তা জানে না ৩৬ শতাংশ মানুষ। যদি পরিস্থিতি খুব সহসাই স্বাভাবিক না হয়, তাহলে ধার দেনার চিন্তা করছেন ১৯ ভাগ মানুষ।
ব্র্যাক জানায়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে ৩৬ শতাংশ উত্তরদাতার স্পষ্ট ধারণা নেই। এ সম্পর্কে শুনেছেন শতকরা ৯৯ দশমিক ৬ ভাগ মানুষ।
ব্র্যাকের সুপারিশ
জরিপের প্রেক্ষিতে কিছু সুপারিশ করেছে ব্র্যাক। সংস্থাটি বলছে, করোনার সংক্রমণ রুখতে সামাজিক দূরত্ব সঠিক বাস্তবায়নের জন্য দেশব্যাপী খাদ্য সংকটে পড়া মানুষের কাছে দ্রুত খাদ্য পৌঁছাতে হবে।
শহর থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে ফিরে গেছেন যাঁরা গ্রামকেন্দ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত নন। তাঁদের কাছে জরুরি খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্র্যাক বলছে, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি শুরু হয়ে বোরো ধান কাটা চলবে মে মাসের শেষ পর্যন্ত। এ সময় কৃষক যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হন এবং সঠিক দাম পান, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আগাম ধান ক্রয় অভিযান পরিচালনা করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা, সংকট পরবর্তী সময়ে গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্ষতি পুষিয়ে পুনরায় ব্যবসা চালু করতে অর্থায়নসহ অন্যান্য সহযোগিতার আগাম পরিকল্পনা করার পরামর্শও দিয়েছে ব্র্যাক।