করোনাভাইরাস: নজিরবিহীন সংকটে বাংলাদেশের গণমাধ্যম
2020.04.13
ঢাকা

বিশ্বব্যাপী সংক্রমিত করোনাভাইরাসের ধাক্কায় নজিরবিহীন সংকটের মুখে পড়েছে দেশের গণমাধ্যম। ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকার মূলধারার নয়টি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশনা। বিক্রি তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে পত্রিকাগুলোর, করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন সংবাদকর্মীরা।
দেশের প্রবীণ ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের মতে, এত বড় সংকটে এ দেশের সংবাদমাধ্যম কখনোই পড়েনি।
“আমার ৪৭ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এমন পরিস্থিতি কখনও দেখিনি। যেসব জায়গায় আমি লিখি, গত তিনমাসে কেউই পয়সা দিতে পারেনি। অনেক নামিদামি পত্রিকাও লেখক সম্মানী দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু গণমাধ্যম হয়ত বন্ধই হয়ে যাবে,” বেনারকে বলেন ৬৮ বছর বয়সী বাংলাদেশি গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে “বেশির ভাগ গণমাধ্যমে বেতন-ভাতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধাদি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে,” বলে গত সপ্তাহে এক বিবৃতিতে জানান সরকারপন্থী বলে পরিচিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) এক অংশের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান।
“স্বাস্থ্যগত বা জীবনের নিরাপত্তা ছাড়াও আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা সংবাদকর্মীদের ব্যাপকভাবে গ্রাস করে চলেছে,” বেনারকে বলেন ডিইউজের অন্য অংশের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী।
গত ২৯ মার্চ এডিটরস গিল্ড বাংলাদেশের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গণমাধ্যমের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার দাবি জানিয়ে বলেন, “এমন বৈরী পরিস্থিতি আর আসেনি। গণমাধ্যম উদ্যোক্তাদের ভাবতে হচ্ছে, চলমান সংকট দীর্ঘ হলে তারা সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেতন দেবে কীভাবে?”
নয় পত্রিকার মুদ্রণ বন্ধ
করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে নয়টি দৈনিকের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) পরিচালনা বোর্ডের সদস্য শেখ মামুন-অর-রশীদ।
তিনি জানান, সর্বশেষ দৈনিক দিনকালের মুদ্রণ বন্ধ হয়েছে শুক্রবার। এ ছাড়া গত ২৬ মার্চ থেকে ৮ এপ্রিলের মধ্যে বন্ধ হয়েছে ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং বাংলা দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ, বাংলাদেশের খবর, সংগ্রাম, সময়ের আলো, মানবজমিন, শেয়ারবিজ কড়চা এবং জনতার মুদ্রণ।
সাংবাদিক নেতারা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কর্মীদের চলতি ও বকেয়া পাওনার সুরাহা না করেই কয়েক লাইনের নোটিশে সংবাদপত্রের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা চরম অমানবিক ও বেআইনি।
রাজধানীর বাইরেও শত শত সংবাদপত্রের প্রকাশনা স্থগিত করা হয়েছে জানিয়ে শেখ মামুন বলেন, “যদি কোনও গণমাধ্যম মালিক করোনা পরিস্থিতেকে পুঁজি করে কর্মীদের বেতন আটকে রেখে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন, শত শত মানুষকে বেকার করেন, তবে সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো বসে থাকবে না, অবশ্যই কড়া প্রতিবাদ জানানো হবে।
“বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও ২৫ শতাংশের বেতন ঝু্লে আছে,” মন্তব্য করে কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, “তথ্যমন্ত্রী সব গণমাধ্যম মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অচিরেই একটি বিবৃতি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন।”
“বর্তমানে ডাক্তার, নার্স এবং আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সবচেয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। এই অবস্থায় মালিকদের উচিত ছিল অনেক বেশি মানবিক এবং সুবিবেচনাপ্রসূত আচরণ করা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন আচরণ সাংবাদিকেরা পাচ্ছেন না,” বলেন শেখ মামুন।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তৈরি সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সাংবাদিক, সংবাদপত্র মালিক ও সম্পাদকদের বিভিন্ন ফোরামের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত ঘোষিত প্রণোদনাগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ নেই।
এর আগে সাংবাদিকদের স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা ও পেশাগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিয়মিত বেতন–ভাতাসহ আপদকালীন প্রণোদনা নিশ্চিত করতে গত বৃহস্পতিবার মালিকপক্ষ ও সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
“এই ক্রান্তিকালে সরকার প্রধান বিভিন্ন শ্রেণী–পেশার জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের দুরবস্থা সম্পর্কে অবগত। আমাদের প্রত্যাশা, তিনি অবশ্যই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন,” বলেন শেখ মামুন।
সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সারাদেশে তালিাকভুক্ত দৈনিকের সংখ্যা ৫৫১টি। এর মধ্যে ঢাকা থেকে ২৫৪টি ও ঢাকার বাইরে থেকে প্রকাশিত হয় ২৯৭টি পত্রিকা।
মহাবিপদে হকাররা
ভাইরাস ছড়ানোর আতঙ্কে রাজধানীতেই দৈনিক পত্রিকা বিক্রির পরিমাণ মারাত্মকভাবে কমে গেছে বলে বেনারকে জানান ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে মার্চের ২৩ তারিখ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই পত্রিকা বিক্রি কমতে শুরু করে জানিয়ে আব্দুল মান্নান বলেন, “এখন খুবই খারাপ অবস্থা।”
সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে এই আশঙ্কায় লোকজন পত্রিকা নেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে মিরপুর এলাকার পরিবেশক মোহাম্মদ সেলিম বেনারকে বলেন, “এখানে দৈনিকের বিক্রি ৯০ শতাংশ কমে গেছে।”
ঢাকার সাত হাজার হকারের মধ্যে বর্তমানে বড় জোর ১৭-১৮শ টিকে রয়েছেন জানিয়ে মান্নান বলেন, “যে হকার তিনশ থেকে পাঁচশ পত্রিকা বিক্রি করতেন, তিনি এখন মাত্র ৫০-৭০টি বিক্রি করতে পারছেন।”
আক্রান্ত ছয় সাংবাদিক
রোববার পর্যন্ত ঢাকায় ছয়জন সাংবাদিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে বেনারকে জানান ডিইউজের নেতা ও নাগরিক টিভির সাংবাদিক রাজু হামিদ।
আক্রান্তদের মধ্যে চারজনই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মী জানিয়ে রাজু বলেন, “মাঠে কর্মরত সব সাংবাদিকের সুরক্ষা সামগ্রী নেই।”
শনিবার ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের নেতাদের সাথে আলাপকালে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেন, “কয়েকজন সংবাদকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অনেককে কোয়ারেন্টাইনেও থাকতে হচ্ছে। সুতরাং তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।”
এই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে কীভাবে সংবাদকর্মীদের সহায়তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা দেয়া যায়, সে বিষয়টি ভাবা হচ্ছে বলেও জানান মন্ত্রী।
এদিকে সোমবার এক বিবৃতিতে সাংবাদিকদের কারো করোনাভাইরাস পরীক্ষার প্রয়োজন হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন হাছান মাহমুদ।
সাংবাদিকদের বিষয়টি বিএসএমএমইউ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে বলে জানান তথ্যমন্ত্রী।
গত ডিসেম্বরে চীন থেকে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হন ৮ মার্চ আর প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সোমবার পর্যন্ত দেশে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৮০৩, মৃত্যু হয়েছে ৩৯ জনের।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সোমবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১৯ লাখ ৪ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন এক লাখ ১৮ হাজারেরও বেশি।