করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা হাজার পার, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী শতাধিক

পুলক ঘটক
2020.04.14
ঢাকা
020414_BD_COVID_1000.jpg করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম পরে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করছেন একজন স্বাস্থ্যকর্মী। ৪ এপ্রিল ২০২০।
[বেনারনিউজ]

একদিনে এ যাবতকালের সর্বাধিক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করেছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার নতুন ২০৯ জন রোগী শনাক্ত হওয়ায় করোনায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার অতিক্রম করেছে। পাশাপাশি, এই দিনে করোনায় সাতজনের মৃত্যু ঘটেছে, যা এ পর্যন্ত একদিনে মৃত্যুর সংখ্যার দিক দিয়েও সর্বোচ্চ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত বিফ্রিংয়ে মঙ্গলবার দুপুরে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত মারা গেছেন ৪৬ জন।

বাংলাদেশে আক্রান্তদের একটি বড় অংশই চিকিৎসক, যারা করোনা মোকাবেলায় সামনের সারির যোদ্ধা। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) ও বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযাযী, দেশে এ পর্যন্ত অর্ধ-শতাধিক ডাক্তারসহ প্রায় ১০০ স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। কোয়ারেন্টাইনে আছেন আরও প্রায় দুই শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মী।

ডক্টরস ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক ডা. নিরুপম দাস বেনারকে বলেছেন, “আজ দুপুর পর্যন্ত ৫৪ জন ডাক্তার করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত হয়েছি। আরও ছয়জনের রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে বলে শুনেছি। সেটা নিশ্চিত হলে আক্রান্তের সংখ্যা হবে ৬০ জন।”

“ডাক্তার ছাড়াও নার্স, ওয়ার্ডবয়, সহকারী, ক্লিনার, বেসরকারি ক্লিনিকের ম্যানেজার, অ্যাম্বুলেন্স চালক ইত্যাদি মিলিয়ে শতাধিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী মানুষ আক্রান্ত আছেন,” বলেছেন ডা. নিরুপম।

করোনাভাইরাসে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের সংখ্যা দেশের মোট আক্রান্তের প্রায় ১০ শতাংশ, আর শুধু ডাক্তারদের সংখ্যা পাঁচ শতাংশেরও বেশি।

“ডাক্তারেরা জীবন বাজি রেখে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। এ কারণে তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি,” বলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তদের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম।

গত ডিসেম্বরে চীন থেকে সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন সাড়ে ১৯ লাখের বেশি মানুষ, মারা গেছেন এক লাখ ২৪ হাজারেরও বেশি।

ভেঙ্গে পড়েছে স্বাস্থ্যসেবা

করোনাভাইরাসে সংক্রমণের ঝুঁকি অত্যধিক হওয়ায় ডাক্তাররা তাঁদের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের দেহে করোনা শনাক্ত হওয়ায় বিভিন্ন স্থানে অনেক ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং বেসরকারি ক্লিনিক লকডাউনের কবলে পড়েছে।

ফলে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে। জরুরি অস্ত্রোপচারের মতো সেবা না পেয়ে বিভিন্ন স্থানে অনেকেই সমস্যায় পড়ছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে “ডাক্তারদের প্রাইভেট কনসালটেশন বড় সমস্যা নয়। পুরানো রোগীরা টেলিফোনে বা অনলাইনে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিচ্ছেন,” মন্তব্য করে বিএমএ’র সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বেনারকে বলেন, “বড় সমস্যা হল জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে; বিশেষ করে যেখানে সার্জারি জরুরি।”

“সারা পৃথিবীতে এই অবস্থা চলছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্কাইপের মাধ্যমে অনেকেই এখন চিকিৎসা পরামর্শ দিচ্ছেন। আপতকালে এটা মানতে হচ্ছে,” বেনারকে বলেন বিএমএ’র মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল।

এই রকম বাস্তবতাকে মোকাবেলার জন্য একটি উপযুক্ত কৌশল প্রণয়ন করা সরকারের উচিত ছিল বলে মনে করেন ডা. রশিদ-ই-মাহবুব।

তিনি বলেন, “করোনা এবং নন করোনা ট্রিটমেন্ট সম্পূর্ণ আলাদা করে দেয়া উচিত ছিল। প্রাইভেট মেডিকেলে শুধু নন করোনা রেখে করোনার চিকিৎসা সরকারি মেডিকেলে করা দরকার ছিল।”

তবে “মানবিক প্রয়োজনেই” খুব দ্রুত এই সমস্যা মোকাবেলার “একটা সিস্টেম তৈরি হয়ে যাবে,” বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ডা. মাহবুব।

স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি আক্রান্ত নারায়ণগঞ্জে

স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে।

নারায়ণগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী মো. ইকবাল বাহার বেনারকে জানান, “জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইমতিয়াজ এবং সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও জেলা করোনা ফোকাল পারসন ডা. মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলামসহ অন্তত ১১ জন স্বাস্থ্যকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।”

এছাড়া বেশ কিছু স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরে করোনার উপসর্গ থাকায় তাঁদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে বলে বেনারকে জানান নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসা​র ডা. আসাদুজ্জামান।

“সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে জেলার মোট ৪২ টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ১০ টিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন,” জানিয়ে নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা ও দৈনিক ভোরের কাগজের প্রতিনিধি আফজাল হোসেন পন্টি বেনারকে বলেন, “এতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।”

সেবা দিতে ভয়

বাংলাদেশে করোনায় মারা যাওয়া দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার একজন সাবেক অধ্যক্ষ। প্রয়াত ব্যক্তির পুত্র ব্যাংক কর্মকর্তা ফুয়াদ আব্দুল্লাহ আল ফারুক কীভাবে তিনি অসুস্থ পিতাকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছেন তার আবেগঘন বর্ণনা ফেসবুকে তুলে ধরেন ২২ মার্চ। রোগীর দেহে করোনার লক্ষণ থাকায় সরকারি বা বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই জায়গা পাননি ওই প্রবীণ শিক্ষক।

শেষ পর্যন্ত নগরীর ডেল্টা হাসপাতালের ডাক্তাররা তাঁর করোনার লক্ষণ না জেনে তাঁকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে আক্রান্ত হন ডেল্টা হাসপাতালের একজন চিকিৎসক।

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় সোমবার সন্তান প্রসব করা একজন মায়ের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিশ্চিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. শামস উদ্দিন।

ফলে ওই মায়ের অস্ত্রোপচারের দায়িত্ব পালনকারী ডাক্তারসহ তাঁর সংস্পর্শে আসা ছয়জন স্বাস্থ্যকর্মীকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।

“স্বাস্থ্যসেবীদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাই রোগীদের সংস্পর্শে গিয়ে সেবা দিতে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী ভয় পাচ্ছেন,” বেনারকে বলেন বিএমএ মহাসচিব ডা: এহতেশামুল হক।

তিনি বলেন, “প্রথম দিকে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রি (পিপিই) নিয়ে সংকট ছিল। তবে সে সময় রোগীর সংখ্যাও বেশি ছিল না। রোগী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পিপিইর সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে।”

“তবে নানারকম সংকট ও ঝুঁকি তো আছেই। এগুলো এখন সব দেশেই। এর মধ্যেই আমাদের সহকর্মীরা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন,” জানান তিনি।

চিকিৎসক ও নার্সদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পিপিই না থাকার কথা প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন ডাক্তাররা।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বেনারকে বলেছেন, “পিপিইর সংকট একেবারে শেষ হয়ে গেছে বলব না, তবে এখন আর সেটা প্রকট নয়। সকল মেডিকেলে চিকিৎসক ও নার্সদের প্রতিদিন পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে।”

সোমবার নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, “করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে চেম্বারে বসছেন না অনেক চিকিৎসক। অনেক জায়গায় টেকনিশিয়ানরা কর্মস্থলে না থাকায় রোগ নির্ণয়ের পরীক্ষাও বন্ধ আছে বলে রোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ আসছে।”

স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রণোদনা

প্রত্যক্ষভাবে করোনাভাইরাস রোগীদের নিয়ে কাজ করা চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশেষ সম্মানী প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

এজন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বলে সোমবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের স্বাস্থ্যবিমা ও জীবনবিমা বাবদ ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর এই বিশেষ সম্মানী ও প্রণোদনাকে চিকিৎ​সকসমাজ স্বাগত জানিয়েছে বলে বেনারকে জানান ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত চিকিৎসক রয়েছেন এক লাখের ওপরে, যার ভেতর ডেন্টাল চিকিৎসক আছেন প্রায় ১০ হাজার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সরকারি স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত রয়েছেন ২৫ হাজার ৬১৫ জন চিকিৎসক।

এদিকে রাজধানীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবাদানকারী চিকিৎসক, সেবিকা ও অন্য সদস্যদের অবস্থান কিংবা কোয়ারেন্টিনের জন্য ঢাকার ১৯টি আবাসিক হোটেল বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে ওইসব হোটেলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য মঙ্গলবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

বেতনের দাবিতে রাস্তায় পোশাক শ্রমিকরা

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির কারণে মঙ্গলবার পর্যন্ত তিনশ ১৬ কোটি ডলারের রপ্তানি বাতিল হয়ে গেছে বলে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ওয়েবসাইটে।

তৈরি পোশাক খাতের এই সংকট মোকাবেলায় গত ২৫ মার্চ এই খাতের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। তবে শ্রমিকদের দাবি, কারখানাগুলোতে অর্ডার বাতিল হওয়ার পর থেকে তাঁরা বেতন পাননি।

বেতনের দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকরা সোমবার রাস্তায় নেমে আসেন। সড়ক অবরোধ করে তাঁরা বলেন, করোনাভাইরাসের চেয়ে ক্ষুধায় মৃত্যুর ভয় তাঁদের বেশি।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের জাতীয় রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশ আসে গার্মেন্টস খাত থেকে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।