করোনাভাইরাস: এক সপ্তায় রোগী বেড়েছে চারগুণের বেশি, মৃত্যু প্রায় তিনগুণ
2020.04.17
ঢাকা

চলতি সপ্তায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে চারগুণের বেশি, মৃতের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ। সংক্রমণ রোধে লোকজনকে ঘরে আটকে রাখতে তাঁদের চাল-ডাল পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃতদের জানাজা পর্যন্ত করতে হচ্ছে প্রশাসন ও পুলিশকে।
ফলে ঝুঁকি বাড়ছে তাঁদের, আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ১৫ জন, যা এ পর্যন্ত একদিনে মৃত্যুর সর্বোচ্চ সংখ্যা। এছাড়া শুক্রবার দেশে পাওয়া গেছে নতুন ২৬৬ জন করোনাভাইরাস রোগী।
করোনাভাইরাস সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে শুক্রবার কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানান।
সরকারি তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো তিনজন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হন ৮ মার্চ, যা এক মাসের বেশি সময় ধরে বেড়ে গত ১০ এপ্রিল পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায় ৪২৪ জনে। কিন্তু মাত্র এক সপ্তায় আক্রান্তের সংখ্যা চার গুণের বেশি বেড়ে শুক্রবারে এসে পৌঁছেছে এক হাজার ১,৮৩৮ জনে। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৫৮ জন।
করোনাভাইরাসে দেশে গত ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যু ঘটার পর ১০ এপ্রিল পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ছিল ২৭ জন, যা মাত্র এক সপ্তায় প্রায় তিনগুণ বেড়ে শুক্রবারে দাঁড়িয়েছে ৭৫ জনে।
এ অবস্থায় সংক্রমণ এড়াতে সবাইকে ঘরে থাকা ও স্বাস্থ্য নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সরকারের রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, এখন পর্যন্ত দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শতকরা ৪৬ ভাগ ঢাকা ও ২০ নারায়ণগঞ্জের।
পাশাপাশি, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, মুনশিগঞ্জ ও চট্টগ্রামেও করোনা রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে জানিয়ে ডা. ফ্লোরা বলেন, আক্রান্তদের মধ্যে শতকরা ৬৮ ভাগ পুরুষ ও ৩২ ভাগ নারী।
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীন থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, শুক্রবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২২ লাখ ১৫ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দেড় লাখেরও বেশি।
ঝুঁকিতে প্রশাসন, স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশ
দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর প্রকাশের পর থেকেই প্রশাসন ও পুলিশ তাঁদের তৎপরতা শুরু করে। ২৪ মার্চ থেকে প্রশাসনের সহযোগিতায় কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী।
নির্দেশনামতো প্রশাসন ও পুলিশের মূল দায়িত্ব কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন নিশ্চিত করা এবং ত্রাণ বিতরণ করা হলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাঁদেরকে নির্ধারিত দায়িত্বের বাইরে গিয়েও কাজ করতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।
বৃহস্পতিবার ঢাকা বিভাগীয় কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেন। সেখানে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার প্রধানমন্ত্রীকে জানান, “এরই মধ্যে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ এবং মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন।”
তবে তিনি আক্রান্তদের সংখ্যা প্রকাশ করেননি।
এখন পর্যন্ত সারা দেশে ১৫ জনের মতো পুলিশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে শুক্রবার বেনারকে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক সোহেল রানা। তবে পুলিশের মধ্যে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫৮ জন বলে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানায় দৈনিক প্রথম আলো।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত বুধবার মারা যান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. মঈন উদ্দিন। চিকিৎসকদের মধ্যে করোনাভাইরাসে এটিই প্রথম মৃত্যু।
বর্তামানে দেশে অন্তত আশি জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রয়েছেন বলে বেনারকে জানান বাংলাদেশ ডক্টর্স ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র নিরূপম দাশ।
“এর বাইরে আছেন নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা,” বলেন তিনি।
করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজে যুক্ত ছয়জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন জানিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলতাফ আলী বেনারকে বলেন, “এদের মধ্যে আইইডিসিআরে কর্মরত আছেন চারজন।"
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা দুই লাখের কিছু বেশি। নিবন্ধিত চিকিৎসক রয়েছেন এক লাখের ওপরে, যার মধ্যে সরকারি স্বাস্থ্যখাতে রয়েছেন সাড়ে ২৫ হাজার থেকে কিছু বেশি চিকিৎসক।
কাঁচাবাজার থেকে জানাজা পর্যন্ত
ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে শনিবার মারা যান ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের এক বাসিন্দা। মৃতের প্রতি শেষ সম্মানটুকু দেখাতে স্থানীয় বাসিন্দারা তো ননই, এমনকি মসজিদের ইমামও এগিয়ে আসেননি।
শেষ পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজন, প্রশাসন ও পুলিশ এগিয়ে আসে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কবর খনন করে। বাঁশ কাটা ও লাশ বহনের দায়িত্ব নেন ঝিনাইদহ সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশারসহ অন্যান্য সদস্যরা আর আর জানাজা পড়ান ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান শুভ।
“এমন একটা অবস্থা হয়েছে, মানুষ মৃতদেহ দেখলে পালিয়ে যাচ্ছেন। মৃতের সৎকারের সময় কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। মৃত ব্যক্তির শেষ সম্মানটুকু দেয়ারই চেষ্টা করেছি আমরা,” বেনারকে বলেন মো. বদরুদ্দোজা শুভ।
রোববার দিবাগত রাতে টাঙ্গাইলের সখিপুরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে এক মাকে তাঁর সন্তানেরা ফেলে রেখে যান। সেখান থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসমাউল হুসনা তাঁকে উদ্ধার করেন।
যশোরের মণিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান শরীফী বেনারকে বলেন, “সরকার থেকে যে ত্রাণ বরাদ্দ হয়েছে সেটা আমরা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি। হতদরিদ্র মানুষকে যেন ঘর থেকে বের হতে না হয়, সে চেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখব।”
সোমবার ঢাকার বংশাল এলাকার বড় অংশ লকডাউন থাকায় পুলিশ নাজিম উদ্দিন রোড, আলী নেকী দেউরী রোডের তিনশ বাড়িতে চাল, ডাল , তেল, আলু, পেঁয়াজ, আটা, লবণ, ডেটল সাবান ও মাস্ক পৌঁছে দিয়েছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
পুলিশের দায়িত্ব সংক্রামক ব্যাধি আইন বাস্তবায়ন হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় তাঁদের অনেক কিছু করতে হচ্ছে বলে বেনারকে জানান পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সোহেল রানা।
“পরিস্থিতি এমন যে পুলিশ শুধু আইন প্রয়োগের কাজে সীমাবদ্ধ থাকেনি,” মন্তব্য করে সোহেল রানা বলেন, “অনেকে পুলিশকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য ফোন করছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বা করোনা উপসর্গ নিয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের সমাহিত করতেও সহযোগিতা চাওয়া হচ্ছে ৯৯৯-এ।”
“পুলিশও সাধ্যমতো চেষ্টা করছে,” বলেন তিনি।
এদিকে “পুলিশ সদস্যদের নিজেদের ও পরিবারের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে কাজ করতে বলা হয়েছে,” বলে সোমবার অনলাইনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান বিদায়ী পুলিশ মহাপরিদর্শক মো জাবেদ পাটোয়ারী।
দায়িত্ব পালনকালে অধীনস্থদের সুরক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে কি না সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকেও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
তবে কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সুরক্ষা সরঞ্জাম বলতে পুলিশের পুঁজি হ্যান্ড গ্লাভস ও মাস্ক, কোথাও কোথাও সংক্রমণ এড়াতে পুলিশ সদস্যরা রেইনকোট পরেও দায়িত্ব পালন করছেন।
সংক্রমণ রোধে বেসামরিক প্রশাশনের পাশাপাশি সেনা সদস্যরা যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ, জনসচেতনতামূলক কাজ, জনসমাগম রোধ ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা ছাড়াও জীবাণুনাশক ছড়াচ্ছেন বলে বেনারকে ইমেইলে জানান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খান।