করোনাভাইরাসে মৃত্যু ১০০ ছাড়ালো, আক্রান্ত প্রায় তিন হাজার

শরীফ খিয়াম ও জেসমিন পাপড়ি
2020.04.20
ঢাকা
200420-BD-covid-funeral-620.jpg জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় অংশ নেন লক্ষাধিক মানুষ। ১৮ এপ্রিল ২০২০।
[বেনারনিউজ]

জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক ধর্মীয় নেতার জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের অংশ নেওয়ার বিষয়টি এখন ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। এরই মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার।

সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে জানানো হয়, বিগত ২৪ ঘন্টায় ৪৯২ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত করা হয়েছে, এই সময়ে মারা গেছেন আক্রান্ত ১০ জন।

এর ফলে সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার ৪৪ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০১ জন, আর মোট আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার ৯৪৮ জন।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জানাজায় এই জনসমাগম বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ  বাংলাদেশে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. রুহুল ফুরকান সিদ্দিক বেনারকে বলেন, “সংখ্যাটা এখন আস্তে আস্তে আরও বাড়বে। জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধির ধরনটা এমনই। প্রথমে কম সংখ্যায় বাড়লেও পরে শত শত, হাজার হাজার বা হাজারের বেশি হারে বাড়তে থাকে।”

“করোনাভাইরাসে মৃত্যুর আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে নজর দিলেও বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে,” যোগ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের এই অধ্যাপক।

বৈশ্বিক হিসাবে করোনায় মৃতের সংখ্যা এক থেকে প্রথম ৫০ হাজারে পৌঁছাতে লেগেছে ৮২ দিন, আর পরবর্তী ১৫ দিনে মারা গেছেন লক্ষাধিক।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সোমবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪ লাখ ৬৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন এক লাখ ৬৮ হাজারেরও বেশি।

“তবে হা-হুতাশের বা ভয় দেখানোর দরকার নেই। এখনও সময় আছে। আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়াটাই অনেক বেশি জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং সরকারের নির্দেশাবলী এখন ধর্মীয় শিষ্টাচারের মতো পালন করতে হবে,” বেনারকে বলেন ড. রুহুল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক কর্মকর্তা ড. রুহুলের দাবি, “আমরা করোনার প্রবেশই ঠেকিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু সেটি পারিনি। তবে সারা বিশ্ব বা ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় আমাদের অবস্থা এখনও অনেক ভালো আছে।”

“সরকারের ভুল-ভ্রান্তি বা সমন্বয়হীনতা নিয়ে সমালোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু জনগণেরও ভুল আছে। ভাইরাস থেকে বাঁচতে হলে আমাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। অনেক বেশি সাবধান হতে হবে,” বলেন তিনি

নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সোমবার সবাইকে হুঁশিয়ার করে বলেন, “আমরা যেন ঘরে থাকি। আমরা যেন মাস্ক ব্যবহার করি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। না হলে মৃত্যুর মিছিল আমরা থামাতে পারব না।”

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার পরে ১৮ মার্চ এই ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম ব্যক্তির মৃত্যুর কথা জানায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।

করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে সরকার ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, যা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছাড়াতে সময় লেগেছে ৩৩ দিন। এর আগে মৃত্যুর সংখ্যা ৫০ ছুঁয়েছিল গত ১৫ এপ্রিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রথম ৫০ জন মারা গেছেন ২৮ দিনে। এরপর মাত্র পাঁচদিনে মারা গেছেন ৫১ জন।

“আমরা বারবার দেশের মানুষকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়াবহতা অনুধাবন করার এবং ঘরে থাকার আহবান জানিয়ে যাচ্ছি। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে করোনাভাইরাসের নতুন সংক্রমণ এবং মৃত্যু ঠেকাতে। কিন্তু মানুষ বাড়িতে থাকার সরকারি আদেশ মানছে না,” বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

“মানুষ ঘরে না থাকলে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” বলেন তিনি।

সরাইলে ৮ গ্রাম লক ডাউন

গত শনিবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে বেড়তলা এলাকার জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা মাঠে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজা অুনষ্ঠিত হয়। ওই জানাজায় মাদ্রাসা মাঠের পাশাপাশি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে প্রায় দুই কিলোমিটার জুড়ে অংশ নেন লক্ষাধিক মানুষ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিসুর রহমান বেনারকে বলেছেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পূর্বপরিকল্পিতভাবে জানাজা আয়োজন করেছিলেন নাকি হঠাৎ করে ওই সমাগম ঘটেছিল তা জানতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে।

“জানাজায় যেসব গ্রামের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন এমন অন্তত আটটি গ্রামকে আমরা লক ডাউন করেছি। এসব গ্রামের লোকজনকে বাধ্যতামূলক ১৪ দিনের কোয়রেন্টিনে থাকতে হবে। যদি তাঁরা এ আদেশ অমান্য করে জনসামগম ঘটান তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।

জামিয়া রহমানিয়া বেড়তলা মাদ্রাসার সহকারী অধ্যক্ষ আমানুল হক বেনারকে বলেন, মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আনসারীর জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য তাঁরা কাউকে অনুরোধ করেননি।

“মাওলানা আনসারী একজন ইসলামিক আলেম। কমপক্ষে ১০ লাখ অনুসারী ইউটিউবে তাঁর বক্তব্য শোনেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে মাদ্রাসা চত্বরে লোক আসতে শুরু করে। আমাদের কোনো ধারণা ছিল না যে, সেখানে জনস্রোত হবে,” বলেন তিনি।

“সশস্ত্র বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মানুষ ঘরে থাকার সরকারি আদেশ মানছে না। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ার কারণে, আগামীতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে জনগণকে সরকারি আদেশ মানতে বাধ্য করা হবে,” বেনারকে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গাজীপুরে আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সারা দেশের প্রায় ২০ শতাংশ রোগী গাজীপুরের। এছাড়া কিশোরগঞ্জে ১৩ শতাংশের কিছু বেশি ও নরসিংদীতে ছয় শতাংশ রোগী রয়েছেন। ঢাকায় এবং নারায়ণগঞ্জে আগের মতোই অনেক বেশি রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত গাজীপুরে আক্রান্ত ২৭৯ জনের মধ্যে ৯ জন চিকিৎসক, ১২ জন নার্স ও ৩৪ জন স্বাস্থ্যকর্মীসহ স্বাস্থ্য বিভাগেরই মোট ৫৭ জন রোগী রয়েছেন বলে জানায় অধিদপ্তর।

সিঙ্গাপুরে বাড়ছে আক্রান্ত বাংলাদেশির সংখ্যা

সিঙ্গাপুরে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক বেড়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো।

সিঙ্গাপুরে গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম একজন বাংলাদেশির আক্রান্তের খবর নিশ্চিত করে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সোমবার পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে মোট আক্রান্ত ৮ হাজারের মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় তিন হাজার বলে জানায় বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র।

“সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি শ্রমিকদের মধ্যে অধিক হারে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, তাঁরা সেখানে ডরমিটরিগুলোতে খুব গাদাগাদি করে থাকেন,” বেনারকে বলেন প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ওয়ারবি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান সৈয়দ সাইফুল হক।

“সিঙ্গাপুরের নিয়োগকারীরা তুলনামূলক ভালো,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যেসব শ্রমিক তাঁদের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেন, আশা করি তাঁদের দুঃসময়ে নিয়োগকর্তারা সতায়তা করবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।