করোনাভাইরাসের প্রভাবে ফুল কিনছে না কেউ
2020.04.24
ঢাকা

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাবে থমকে গেছে ফুলের বাজার। সাধারণত পাপড়ি মেলার আগেই কৃষকের বাগান থেকে ফুল চলে যায় বাজারে। কিন্তু এখন ফুল কেনার কেউ নেই, বাগানেই ঝরে পড়ছে ফুল।
দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা যশোর থেকে শুরু করে উত্তরের রংপুর বা ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, সাভারসহ সর্বত্র একই চিত্র।
এই অবস্থায় ফুল চাষ, বিপণন, সাজসজ্জ্বা ও বিদেশে রপ্তানিসহ এ খাতের সাথে জড়িত প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম।
তিনি জানান, “গত ১৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ফুল চাষিরা কোনো ফুল বিক্রি করতে পারেননি। সারা দেশে খুচরা বিক্রেতারাও ফুলের দোকান বন্ধ করে বসে আছেন।”
“কোথাও কোনো উৎসব বা আয়োজন নেই। করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ গৃহবন্দী। এ রকম অবস্থায় ফুল কে নেবে?” বলেন আব্দুর রহিম।
দেশে ফুলের ব্যবসার বড় অংশই এই মৌসুমে হয়ে থাকে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এবং পহেলা বৈশাখে কোটি কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। তা ছাড়া চাষিদের প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে এবার বেশি লাভ হবে। কিন্তু করোনার কারণে সব ধরনের অনুষ্ঠান বাতিল হওয়ায় বড় রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ফুল চাষি এবং ব্যবসায়ীরা।
বর্তমানে দেশের ছয় হাজার হেক্টর জমিতে ১১ ধরনের ফুল চাষ হচ্ছে। এতে করে দেশে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ফুলের বাজার গড়ে উঠেছে। এসব ফুল বিক্রির জন্য দেশজুড়ে প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় দোকান আছে। শুধু রাজধানীতেই রয়েছেন প্রায় সাড়ে চারশ পাইকারি ও তিনশ খুচরা ব্যবসায়ী।
ফ্লাওয়ার সোসাইটির হিসেবে, পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত উৎসব, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস এবং পয়লা বৈশাখের মতো বিশেষ দিবসে প্রায় নয়শ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। যার ৩৫ শতাংশই গোলাপ। এ ছাড়া গ্লাডিওলাস ২৫, রজনীগন্ধা ২০, জারবেরা ১০ এবং গাঁদা ও অন্যান্য ফুল বিক্রি হয় ১০ শতাংশ।
এ বছর পহেলা বৈশাখ এবং স্বাধীনতা দিবস উদযাপন বন্ধ থাকায় ওই দুই দিনেই প্রায় ২৫০ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছেন ফ্লাওয়ার সোসাইটির নেতৃবৃন্দ। গত অর্থ বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও কিছু কিছু ফুল রপ্তানি হয়।
যে পরিস্থিতি ভাবেনি কেউ
বাংলাদেশে ফুলের বাণিজ্যিক চাষ শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত এর প্রসারই দেখেছেন ফুল চাষি ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বর্তমানের মতো স্থবির অবস্থা তাঁরা কখনোই দেখেননি বলে জানিয়েছেন।
নওগাঁর ধামইরহাটের উপহার নার্সারীর মালিক আবু তালেব মন্ডল জাকারিয়া এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ১৩ একর জমিতে ফুল চাষ করেছেন।
“ফুল চাষে এবার আমার মোট বিনিয়োগ প্রায় ১২ লাখ টাকা। ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু বাগানেই শুকিয়ে যাচ্ছে ফুল,” বেনারকে জানান আবু তালেব।
রংপুরের খাসবাগ, বালাটারি, বুড়িরহাট এবং উত্তম এলাকার চাষিরাও একই অবস্থার মুখোমুখি বলে জানিয়েছেন। শহরের উপকন্ঠ খাসবাগে ফুল চাষ করে সমৃদ্ধি লাভ করা আছিয়া বেগম বলেন, “আমরা প্রায় ২৫ বছর ধরে ফুল চাষ করি। এবার এ রকম অবস্থা হবে, কল্পনাও করতে পারিনি।”
“বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর কারণে আশা বেশি ছিল। তাই এবার এক একর জমিতে শুধু গোলাপ লাগিয়েছি। পাঁচ–ছয় লাখ টাকার ফুল জমিতেই শেষ,” বেনারকে বলেন তিনি।
রাজধানীর শাহবাগের ফুল ব্যবসায়ী ও অনন্যা পুষ্প বিতানের মালিক মো. লোকমান হোসেন বেনারকে বলেন, “করোনার প্রভাবটা আমাদের উপর শতভাগ পড়েছে। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় ফুল বিক্রি বন্ধ রয়েছে।”
“কৃষক থেকে শুরু করে এ খাতের সাথে যারা জড়িত, সবাই অনেক লোকসানের মধ্যে রয়েছে,” বলেন তিনি।
“ফুল চাষিদের সমস্যা মূলত দুই দিক থেকে। প্রথমত ভরা মৌসুমে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং দ্বিতীয়ত তারা চাইলেও এখন জমিতে অন্য ফসল আবাদ করতে পারছেন না,” বেনারকে বলেন রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সরওয়ারুল হক।
তিনি বলেন, “ফুল চষের জন্য কৃষকরা দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নেয়। অন্তত ছয় মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে ফুল চাষ করার টার্গেট নিয়ে মাঠ তৈরি করে। তাই চট করে অন্য ফসল আবাদের দিকে যাওয়া কঠিন।”
ইতিমধ্যে ফুল চাষি এবং ব্যবসায়ীদের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে একটি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি। গত ২ এপ্রিল দেওয়া ওই চিঠিতে সম্ভাবনাময় ফুল খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দাবি করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বেনারকে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন তার আওতায় ফুলচাষীদের মাত্র চার শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হবে।”
“যে ক্ষতিটা হচ্ছে তা হয়তো পুরোপুরি পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে সরকারের দিক থেকে তাঁদের জন্য সর্বোচ্চ সহায়তা থাকবে,” বলেন তিনি।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার, যা কয়েক দফায় বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করা হয়েছে। এই সময়ে সব ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাবেশের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এরই অংশ হিসেবে গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস ও ১৪ এপ্রিল পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানও বাতিল করা হয়।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম তিনজন রোগী শনাক্ত হন, এর দশদিন পর ১৮ মার্চ এই রোগে দেশে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুক্রবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা চার হাজার ৬৮৯ জন, মারা গেছেন ১৩১ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সারা বিশ্বে শুক্রবার পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২৭ লাখ ৮৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন এক লাখ ৯৫ হাজারের বেশি।