করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যেও পোশাক কারখানা খুলেছে
2020.04.27
ঢাকা

কোনো রকম প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়া তৈরি পোশাক কারখানা চালু করে হাজার হাজার শ্রমিককে কাজে নামানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতি হবে বলে মনে করছেন শ্রমিক নেতারা। তাঁদের মতে, এতে শুধু শ্রমিকেরাই নন, পুরো দেশকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে।
টানা ২০ দিন বন্ধ থাকার পরে রোববার থেকে সীমিত আকারে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। কারখানা মালিকেরা বলছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সীমিত আকারে কারখানাগুলো চালু করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ সোমবার বেনারকে বলেন, “আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী এলাকাভিত্তিক কিছু কারখানা খোলার কথা ছিল। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, পাঁচশ’র মতো কারখানা খোলার কথা।”
তবে এর বাইরেও কিছু ছোট ফ্যাক্টরি খোলা হতে পারে। তারা হয়তো স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছে,” বলেন তিনি।
ফয়সাল সামাদ বলেন, “আমরা দূরদূরান্ত থেকে শ্রমিকদের আপতত না আনতে প্রত্যেক সদস্যকে অনুরোধ করেছি। পাশাপাশি কাউকে ছাঁটাই না করতেও বলা হয়েছে।”
কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে তিনি বলেন, “সব ধরনের নিরাপত্তা মেনে ফ্যাক্টরি চালু করা হয়েছে। বিজিএমইএ থেকে মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। তারা এলাকাভিত্তিক ফ্যাক্টরিগুলো পরিদর্শন করছে।”
“আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সব মালিকই সচেতন, কেউই চায় না কারখানায় বিপদ ঘটুক,” বলেন ফয়সাল সামাদ।
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত ৫ এপ্রিল থেকে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় বিজিএমইএ এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। ২৬ মার্চ থেকে চলা সরকারি ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে তা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর সরকারের সঙ্গে পরামর্শক্রমে রোববার থেকে ধাপে ধাপে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠন দুটি।
ওই সিদ্ধান্তের আলোকে ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রামেও বেশকিছু কারখানা খোলা হয়েছে, সেখানে কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিকেরা।
বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি আবদুস সালাম বেনারকে বলেন, “চট্টগ্রামে ৩২৬টি কারখানার মধ্যে ১২০ থেকে ১৩০টি খুলেছে। সেখানকার সবগুলোই ছোট ছোট কারখানা।”
“সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মানার সর্বোচ্চ চেষ্টা হচ্ছে," বলেন তিনি।
বিকেএমইএ’র সহ–সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বেনারকে বলেন, “সোমবার পর্যন্ত আমাদের ২০-২৫ শতাংশ কারখানা খুলেছে। আপাতত নিটিং এবং ডায়িংসহ কিছু শাখা চালু হয়েছে। ২ এপ্রিল থেকে গার্মেন্টস সেকশনগুলো চালু হবে।”
তিনি বলেন, “সব কারখানা খোলা হবে কিনা, সেটা এখনই বলা যাবে না। কারণ, অনেকের হাতে কাজ নেই। যারা কারখানা খুলেছেন, তারাও পুরোপুরি চালু করেননি। কারণ, অত পরিমাণ কাজ নেই। তা ছাড়া কারখানা পুরোদমে চালু করলে কর্মীদের সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা যাবে না।”
এখন পর্যন্ত নুতন অর্ডার আসেনি জানিয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “এখন কারখানা খোলা হচ্ছে আগের অর্ডারের জন্য। অনেক ক্রেতা পূর্বের অর্ডার করা পণ্য চেয়েছেন। সেগুলো পাঠাতে বলেছেন।”
করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত বিজিএমইএ’র তিনশ কোটি ডলারের বেশি ও বিকেএমইএ’র দুইশ কোটি ডলারের বেশি টাকার ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
তবে শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করেছেন, ঢাকায় থাকা শ্রমিকদের নিয়ে কারখানা খোলার কথা বলা হলেও দূর দূরান্ত থেকে শ্রমিকদের ডেকে আনা হচ্ছে। দেশজুড়ে পরিবহন বন্ধ থাকলেও চাকরি বাঁচাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা কর্মস্থলে যাচ্ছেন। এসব করতে গিয়ে স্বাস্থ্যবিধি লংঘন হচ্ছে।
কয়েকটি স্থানে শ্রমিকদের অনাগ্রহে কয়েকটি কারখানা চালুর পর আবার বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনেও নেমেছেন বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বেনারকে বলেন, “সীমিত আকারে কারখানা খুলে ঢাকার শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকেও শ্রমিকদের ফোন করে আনা হচ্ছে। এ ছাড়া বেশিরভাগ কারখানায় দফায় দফায় লে অফ ও ছাঁটাই চলছে। ফলে শ্রমিকদের স্থির থাকার মতো অবস্থা নেই।”
“স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছেন, মে মাসে দেশে করোনাভাইরাসের ঝুঁকি আরো বাড়বে। সেই সময় কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া একেকবার একেক কথা বলে শ্রমিকদের ডেকে আনলে তাঁদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে, এতে পুরো দেশবাসী ঝুঁকিতে পড়বে,” বলেন তিনি।
তাসলিমা আখতার অভিযোগ করেন, “সরকারি কর্মকর্তা বা অন্যদের বিষয়ে সরকার জোরালোভাবে বাসায় থাকার কথা বললেও শ্রমিকদের বিষয়ে কখনো সে কথা জোর দিয়ে বলেনি, এটা দুঃখজনক।”
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায় বেনারকে বলেন, “আমাদের কাছে বিভিন্ন এলাকায় তিন শতাধিক কারখানা খোলার তথ্য রয়েছে। এসব কারখানায় সরকারের স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না, সেটা আমরা মনিটরিং করব। যারা কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি মেনে চলছেন না তাঁদের বিরুদ্ধে আইগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
চলছে শ্রমিক আন্দোলন
শ্রমিক নেতারা অভিযোগ করছেন, ঢাকার সন্নিকটে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক কারখানা লে অফ ঘোষণা করা হচ্ছে এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার সাভার এবং গাজীপুরে কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জালাল উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, ভোগড়া এলাকার স্টাইলিস গার্মেন্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ এক মাস আগে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা লে-অফ ঘোষণা করে। লে-অফ ঘোষণার পর বেশ কিছু শ্রমিকের বেতন বকেয়া ছিল।
“সোমবার শ্রমিকেরা কয়েকটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে, তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে। পরে শিল্প পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে,” জানান তিনি।
এদিকে শ্রমিক ছাঁটাই, লে-অফ ও মালিক পক্ষের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। সংগঠনের সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার, সাধারণ সম্পাদক জুলহাস নাইন বাবু এবং সাংগঠনিক সম্পদক আমিনুল ইসলাম শামা এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, “শ্রম প্রতিমন্ত্রী এবং বিজিএমইএর নেতারা মৌখিকভাবে ছাঁটাই, লে-অফ করা হবে না এবং বেতন সময় মতো দেওয়া হবে বললেও কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছামতো কাজ করছে।”
বিবৃতিতে বলা হয়, “একবার কারখানা খোলা, আবার বন্ধ, একবার লে অফ, আবার লে অফ খুলে কাজ করানো—এসব সিদ্ধান্তের ফলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়েছে। এ ছাড়া বেতন না পেয়ে শ্রমিকদের আর্থিক জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।”
বিবৃতিতে শ্রমিকদের পূর্ণ বেতন দিয়ে করোনার বিপদকাল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখার আহবান জানান তাঁরা।
পোশাক খাতকে সুরক্ষার আহ্বান জানালেন বৃটিশ এমপি
পশ্চিমা দেশের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তি বাতিলের কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষতি আটকাতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক বাণ্যিজ বিষয়ক মন্ত্রী ও ট্রেজারির চ্যাণ্সেলরের কাছে সোমবার আবেদন জানিয়েছেন দেশটির বাংলাদেশি বংশদ্ভূত সংসদ সদস্য রুশনারা আলী।
“বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবার কারণে স্থানীয় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে এবং লাখো মানুষ তাঁদের চাকরি হারিয়েছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এর মধ্যে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর পরিস্থিতি সবচেয়ে কঠিন।”
পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর বাণিজ্যিক চুক্তি বাতিলের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষতির উদাহরণ দিয়ে রুশনারা আীল বলেন, এ পর্যন্ত পশ্চিমা ক্রেতারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে ৩৭০ কোটি ডলারের চুক্তি বাতিল করেছেন, যার মধ্যে ২৪০ কোটি ডলার বাতিল করেছে যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলো।
এর ফলে বাংলাদেশের প্রায় দশ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক হয় চাকরি হারিয়েছেন অথবা বেতন পাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে সকল বৃটিশ কোম্পানি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে, তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবার জন্য আমি যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে তাঁরা তাঁদের সরবরাহকারীদের সাথে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে।”
চীনের পর বাংলাদেশই বিশ্বে তৈরি পোশাক প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বৃহত্তম দেশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যদি সরবরাহ ব্যবস্থা ধসে পড়ে, তবে সারা বিশ্বের পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম) তৈরির সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
“বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থা সুরক্ষার উদ্যোগে অবশ্যই যুক্তরাজ্যক নেতৃত্ব দিতে হবে,” বলেন রুশনারা আলী।
দেশে আক্রান্ত প্রায় ছয় হাজার
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯৭ জন, মারা গেছেন সাত জন। এ নিয়ে সোমবার পর্যন্ত দেশে এ রোগে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫ হাজার জন ৯১৩ এবং মারা গেছেন ১৫২ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সোমবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩০ লাখ ২৯ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ১০ হাজারের বেশি।
এদিকে বর্তমান করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে সোমবার জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে গত ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।