করোনাভাইরাস: সাংবাদিক ও পুলিশের মৃত্যু, একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ৬৪১
2020.04.29
ঢাকা

বাংলাদেশে চব্বিশ ঘন্টায় করোনাভাইরাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬৪১ জন আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্যবিভাগ, এই সময়ে মৃতের সংখ্যা আট। এদিকে বুধবার এই প্রথম একজন সাংবাদিক ও একজন পুলিশের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।
ক্রমাগতভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে গার্মেন্টস খুলে দেওয়া ও পর্যায়ক্রমে দোকানপাট খুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের সমালোচনা হচ্ছে। নাগরিকদের ঘরে থাকার বিষয়ে সরকারের নির্দেশ শিথিল হওয়ায় রাস্তাঘাট, বাজার ও দোকানপাটে জনসমাগম বেড়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বেনারকে বলেন, “যখন কভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তখন উচিত অধিকতর সাবধান হওয়া। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখছি, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা উল্টো পথে হাঁটছেন।”
“সম্ভবত নীতি নির্ধারকেরা ভাবছেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে তাঁদের আর কিছুই করার নেই। অথবা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, সবকিছু ছেড়ে দিই। মহামারিতে যারা অসুস্থ হবে হোক, মারা যায় যাক,” বলেন তিনি।
এই মনোভাবের সমালোচনা করে ড. লেলিন বলেন, “সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ আত্মঘাতি, জাতির স্বার্থের বিরোধী।”
উল্লেখ্য, বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৬৪১ জন নতুন আক্রান্তসহ দেশে কভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ৭ হাজার একশ ৩ জনে পৌঁছেছে। এ ছাড়া একই সময়ে আরও আটজনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬৩ জন। বুধবার নিয়মিত বুলেটিনে এসব তথ্য জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, বুধবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১ লাখ ৭৩ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ২৫ হাজারের বেশি।
এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রথম একজন সাংবাদিক এবং একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে গত ১৫ এপ্রিল মারা যান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. মঈন উদ্দিন, চিকিৎসকদের মধ্যে করোনাভাইরাসে সেটিই প্রথম মৃত্যু।
বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বেনারকে জানান, “সারাদেশে এখন পর্যন্ত ৮৩১ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ডাক্তার ৩৫৯ জন, নার্স ১৭৯ এবং স্বাস্থ্যকর্মী ২৯৩ জন।”
গত ২৩ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে ২১৮ জন পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানানো হয়।
সারাদেশে এ পর্যন্ত ২৯ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ। এর মধ্যে পাঁচজন সুস্থ হয়েছেন।
প্রথম সাংবাদিকের মৃত্যু
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী সাংবাদিক হুমায়ুন কবির (৪৭) দৈনিক সময়ের আলোর প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন। করোনার উপসর্গ নিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করার কয়েক ঘণ্টা পরই তাঁর মৃত্যু হয়।
খোকনের ছেলে আশরাফুল আবির বেনারকে বলেন, “আমার বাবা এই করোনা সংকটের সময়েও প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে অফিস করেছেন। অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে তিনিও অফিসের গাড়িতে বাসায় ফিরতেন। এ নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় ছিলাম।”
“বাবা চারদিন থেকে গলাব্যথা, জ্বর এবং কাশিতে ভুগছিলেন। কিন্তু করোনা হয়েছে বলে বিশ্বাস করেননি। ভেবেছিলেন টনসিলের কারণে গলা ব্যথা। গতকাল পরিস্থিতি খারাপ হলে সন্ধ্যার দিকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে ঢোকানোর সময়ই মনে হচ্ছিল তিনি বেঁচে নেই। তবে ডাক্তাররা সর্বশেষ চেষ্টা চালিয়ে রাত ১০ টার দিকে মৃত্যুর কথা জানান,” বলেন তিনি।
প্রয়াত খোকনের স্ত্রীও জ্বরে ভুগছেন বলে জানিয়েছেন আবির।
“সাংবাদিকরা একাধারে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এবং চাকরির ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব শাবান মাহমুদ।
“ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিক ছাটাই করা হয়েছে। অনেক মালিক কর্মরত সাংবাদিক, প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ শ্রমিকদের আংশিক পারিতোষিক অথবা কোনো প্রকার প্রাপ্য না দিয়ে চাকরি থেকে বিদায় দিয়েছেন। অথচ তাঁরা সরকারের কাছে বিশেষ সুবিধা আদায়ের জন্য লবিং করে চলেছেন,” বলেন তিনি।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, “করোনা পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের যে ধরনের নিরাপত্তা দেওয়া দরকার তা প্রায় নেই বললেই চলে। এর মধ্যে রয়েছে চাকুরি নিয়ে অনিশ্চয়তা। সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি বিমা সুবিধা জরুরি। বেআইনি ছাটাই বন্ধের জন্য আমরা সরকার এবং মালিক পক্ষের কাছে বারবার আহ্বান জানাচ্ছি।”
প্রথম পুলিশ সদস্যের মৃত্যু
করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া পুলিশ কনস্টেবল জসিম উদ্দিন (৪০) কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বাসিন্দা। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ওয়ারি থানায় কর্মরত ছিলেন। ওয়ারি ফাঁড়িতে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি করোনায় সংক্রমিত হন বলে বাংলাদেশ পুলিশের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
বুধবার আইইডিসিআর থেকে পুলিশকে জানানো হয়, মারা যাওয়া ওই কনস্টেবল কভিড-১৯ পজিটিভ ছিলেন।
ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন কয়েক দিন আগে জসিম উদ্দিনের শরীরে কভিড-১৯ এর উপসর্গ দেখা দিলে তাঁকে ফকিরাপুলের একটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়। ২৫ এপ্রিল তাঁর নমুনা আইইডিসিআরে পাঠানো হয়। নমুনার ফলাফল আসার পর তাঁকে পুলিশ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে নেওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু মঙ্গলবার অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ সদরদপ্তর বলেছে, “চলমান করোনা-যুদ্ধে দেশের সম্মানিত জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে মো. জসিম উদ্দিনের মৃত্যুতে বাংলাদেশ পুলিশ গভীরভাবে শোকাহত। একই সাথে দেশমাতৃকার সেবায় তাঁর এমন আত্মত্যাগে বাংলাদেশ পুলিশ গর্বিত।”
মসজিদ খোলা প্রসঙ্গ
সরকারি নির্দেশ অমান্য করে মুসল্লিদের জন্য নিজ এলাকার সকল মসজিদ খুলে দেওয়ার ঘোষণার পরদিনই নিজ অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ালেন গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুরের গার্মেন্টস ও আশপাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু খোলা হয়েছে, সেই যুক্তিতে রমজান মাসে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের সুযোগ দিতে মঙ্গলবার এই ঘোষণা দেন তিনি।
তবে বুধবার বিকেলে জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের জানান, তিনি তাঁর আগের বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন।
উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর শিল্প এলাকা। বাংলাদেশে যে সব এলাকায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে, গাজীপুর তার মধ্যে অন্যতম।
ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বেনারকে বলেন, “তাঁর এমন ঘোষণার কঠোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এমন ঘোষণা দেওয়ার কোনো অধিকার মেয়রের নেই।”
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ, ওয়াক্তের নামাজ ও তারাবির নামাজ পড়ার ওপর আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার।