করোনাভাইরাস মোকাবেলা: বেড়েছে ছুটি, সীমিত আকারে খুলছে দোকানপাট
2020.05.04
ঢাকা ও কলকাতা

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে অর্থনীতি সচল রাখতে ১০ মে থেকে ‘সীমিত আকারে’ দোকানপাট, শপিংমল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
একই দিনে রংপুর বিভাগের জনপ্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সে দেশের থমকে যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য ও রোজার মাসের কথা বিবেচনা করে দোকানপাট খোলা রাখা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
“মানুষের স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখে,” অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গে সীমান্ত সংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দা ও শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে পেট্রাপোল-বেনাপোল বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁরা বলছেন, দুই দেশের এই স্থলবন্দর খুলে দেওয়া হলে পশ্চিমবঙ্গে করোনা ঝুঁকি বাড়বে।
বাংলাদেশে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারের ঘোষণার দিনেই ২৪ ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৬৮৮ জন করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত এবং পাঁচ রোগীর মৃত্যুর খবর জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা।
সোমবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মোট রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ১৪৩, এই রোগে মারা গেছেন ১৮২ জন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের আগে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অফিস-আদালত খুলে দিলে দেশে করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে এবং পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।
প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। কয়েক দফায় বাড়ানোর পর সর্বশেষ সোমবার এক প্রজ্ঞাপনে ১৬ মে পর্যন্ত সেই ছুটি দীর্ঘায়িত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ.ফ.ম. রুহুল হকের মতে, দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য সীমিত আকারে দোকানপাট খুলে দেয়া হলেও, এর পরিণাম শুভ হবে না।
তিনি বেনারকে বলেন, “দোকানপাট খুলে দেয়ার ফলে সব মানুষ একসাথে বাজারে যাবে। ফলে করোনা সংক্রমণ আরও বাড়বে।”
সরকার ছুটি বাড়ালেও সাধারণ মানুষ ঘরে না থেকে রাস্তায় বেরিয়েছে মন্তব্য করে রুহুল হক বলেন, “দেশের জনসংখ্যা বিবেচনা করলে শতকরা ১০ ভাগ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার সুবিধা অথবা সামর্থ্য-কোনোটিই আমাদের নেই। ফলে আমাদের দেশ থেকে করোনাভাইরাস দূর করা কঠিন হবে।”
এদিকে দেশের সব মানুষের পক্ষে ঘরে থাকা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মনিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বেনারকে বলেন, “এর বড় কারণ দারিদ্র। আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ আছেন যারা দিন আনেন, দিন খান। এই মানুষদের ঘরে রাখা সম্ভব নয়।”
“সবকিছু মাথায় রেখে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। জীবন ও জীবিকা দুই দেখতে হবে সরকারকে,” বলেন তিনি।
করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় বাংলাদেশের সীমান্ত বন্দর বেনাপোলের সাথে সংযুক্ত ভারতীয় বন্দর পেট্রাপোলের আশপাশের গ্রামবাসী ও পণ্য ওঠানো-নামানোর সাথে যুক্ত শ্রমিকদের ধারাবাহিক আন্দোলনে বন্ধ হয়ে গেছে বন্দর দুটি।
রবি ও সোমবার ভারতীয় অংশের স্থানীয় বাসিন্দারা পেট্রাপোল-যশোর জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন। গ্রামবাসীর সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হন স্থানীয় শ্রমিকরাও।
“ওপারে বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। এই অবস্থায় বাণিজ্য শুরু হওয়া মানেই সংক্রমণের প্রবল আশঙ্কা তৈরি হওয়া। তাই আতঙ্কিত গরিব শ্রমিক ও গ্রামের মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছেন,” বেনারকে বলেন উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পরিষদের মেন্টর এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সাবেক বিধায়ক গোপাল শেঠ।
পেট্রাপলের নিকটবর্তী ছয়ঘরিয়ার বাসিন্দা সুমন হালদার বেনারকে বলেন, “সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে অনেকের করোনা হয়েছে। বেনাপোলের এপারেই আমাদের বাড়ি। আমরা করোনা সংক্রমণের আতঙ্কে রয়েছি। এই অবস্থায় এখন বাণিজ্য শুরু হওয়া মানেই আমাদের বিপদ।”
প্রসঙ্গত করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভারত ও বাংলাদেশ, দুদেশেই সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের কারণে এক মাসেরও বেশি বন্ধ থাকার পর গত বৃহস্পতিবার থেকে পেট্রাপোল-বেনাপোল বন্দর দিয়ে সীমিত আকারে কার্যক্রম শুরু হয়।
“কিছু ব্যবসায়ী নিজেদের স্বার্থে পণ্য রপ্তানি শুরু করেছেন। কিন্তু শ্রমিকদের করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার দিকে নজর দেওয়া হয়নি,” সাংবাদিকদের জানান ভারতীয় বন্দরের ট্রাক লোডিং-আনলোডিং শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী সভাপতি অমিত কুমার বসু।
ক্লিয়ারিং এজেন্টদের সূত্র মতে, স্বাভাবিক সময়ে পেট্রাপোল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় সাতশো ট্রাক পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। এই মুহূর্তে পেট্রাপোলে প্রায় আড়াই হাজার ট্রাক বাংলাদেশে পণ্য পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করছে।
গত বৃহস্পতিবার খোলার পর এই বন্দর দিয়ে মাত্র দুই ট্রাক পাট ও ভুট্টা বীজ বাংলাদেশে রপ্তানি করা হয়। শুক্রবার বন্ধ থাকায় কোনো রপ্তানি হয়নি। শনিবার রপ্তানি হয় ১৩ ট্রাক পণ্য।
পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট অ্যাসেসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, “শ্রমিক ও গ্রামবাসীদের দাবি মেনে রপ্তানি বানিজ্য বন্ধ রাখা হয়।”
সোমবার পর্যন্ত পশ্চিবঙ্গে এক হাজার ২৬৯ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা। এখন পর্যন্ত রাজ্যে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন ৬১ জন।
অন্যদিকে সোমবার পর্যন্ত ভারতে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ হাজার ৮৩৬। এছাড়া এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে এক হাজার ৩৮৯ জন মারা গেছেন বলে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের বুলেটিনে জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, সোমবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৫ লাখ ৭১ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ৫০ হাজারের বেশি।