করোনাভাইরাস: একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু, আক্রান্তের সংখ্যাও সর্বাধিক
2020.05.13
ঢাকা

‘সীমিত আকারে’ দোকানপাট খোলার তিন দিনের মাথায় বুধবার করোনাভাইরাসে দেশে একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগীর মৃত্যু এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক সংক্রমণের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই পরিস্থিতির মধ্যে বুধবার করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে চলমান সাধারণ ছুটির মেয়াদ ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বুধবার অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে জানান, গত ২৪ ঘন্টায় ১৯ জন রোগী করোনাভাইরাসে প্রাণ হারিয়েছেন। আর নতুনভাবে সংক্রমিত হয়েছেন এক হাজার ১৬২ জন। বুধবারই দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যু এবং সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। তবে ঈদ উপলক্ষে ১০ মে থেকে ‘সীমিত আকারে’ দোকানপাট ও ব্যবসা বাণিজ্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
এছাড়া ১১ মে থেকে দেশের সকল মসজিদ পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমাসহ তারাবির নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
দোকানপাট খোলার ঘোষণার পর থেকেই আসন্ন ঈদ উপলক্ষে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মার্কেটে জনসমাগম বেড়ে যায়। সরকারের দেয়া সামাজিক দূরত্বের নিয়ম শিথিল হয়ে পড়ে।
এর প্রেক্ষিতে চলমান সাধারণ ছুটি ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বেনারকে জানান জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
“ঈদের মধ্যে যানবাহন চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে,” জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বৃহস্পতিবার এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম রোগী শনাক্ত হন ৮ মার্চ, এ রোগে প্রথম ব্যক্তির মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮২২ ও মৃত ২৬৯ জনে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে, বুধবার পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৩ লাখ ১৭ হাজারের বেশি মানুষ, মারা গেছেন দুই লাখ ৯৪ হাজারের বেশি।
হাসপাতালে রোগী কমানো হচ্ছে
বর্তমানে একজন করোনাভাইরাস রোগী ভর্তির পর একটানা কমপক্ষে ১৪ দিন হাসপাতালে থাকেন বলে বেনারকে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
তবে যেহেতু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে সেহেতু হাসপাতালে রোগীদের অবস্থানের মেয়াদ কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
বর্তমানে কোনো রোগীর পর পর দুটি পরীক্ষায় করোনাভাইরাস নেগেটিভ না আসা পর্যন্ত তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, এখন থেকে কোনো রোগীর প্রথম পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
“তাঁরা নিজ বাসায় বিশ্রাম নেবেন। টেকনিক্যাল কমিটি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে,” বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, করোনাভাইরাস রোগীদের শতকরা ৮৫ ভাগের বেশি ঢাকা শহর এবং ঢাকা বিভাগের।
করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট করা ঢাকার ১২টি বিশেষায়িত হাসপাতালে বর্তমানে শয্যার সংখ্যা তিন হাজারের বেশি জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, শিগরিই এই শয্যাসংখ্যা প্রায় সাত হাজার হবে।
প্রসঙ্গত, সরকারি হিসাবে, ঢাকা বিভাগে প্রায় চার কোটি ৬৮ লাখ মানুষ বাস করেন।
অন্য রোগে চিকিৎসা পাওয়া কঠিন
বাংলাদেশে বর্তমানে করোনা ছাড়া অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে বলে বেনারকে জানান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ.ফ.ম. রুহুল হক।
তিনি বলেন, “হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীকে হাসপাতালে নেয়া হলে বলা হচ্ছে করোনাভাইরাস পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে আসুন। করোনাভাইরাস পরীক্ষা করাতে করাতে তো রোগী মারা যাবে।”
তাঁর মতে হাসপাতালগুলোর উচিত আগে রোগী ভর্তি করা। এরপর প্রয়োজন মনে করলে তারা রোগীর করোনাভাইরাস পরীক্ষা করবে বা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাবে।
“বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থা আরও খারাপ,” মন্তব্য করে রুহুল হক বলেন, “স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত ডাক্তার ও অন্যান্য সকল স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে রোগীদের সেবা পাওয়ার ব্যবস্থা করা।”
করোনার রোগী না হয়েও বলতে গেলে গত শনিবার বিনা চিকিৎসায় মারা যান সরকারের এক অতিরিক্ত সচিব গৌতম আইচ, যার মেয়ে নিজেও করোনাভাইরাস রোগীদের সেবাদানকারী একজন ডাক্তার।
গৌতম আইচ কিডনি রোগী ছিলেন জানিয়ে মেয়ে সুস্মিতা আইচ নিজের ফেসবুকে জানান, বৃহস্পতিবার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালিসিসের সময় হঠাৎ তাঁর বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে।
ওই হাসপাতালে থেকে তিনি তাঁর বাবাকে ঢাকার নামকরা তিনটি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও কেউই তাঁকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি।
পরে গৌতম আইচকে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি শনিবার মারা যান।
সুস্মিতা আইচ জানান, ডায়ালিসিসের সময় তাঁর বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হতো, ফুসফুসে পানি চলে আসত। আইসিইউ সাপোর্ট থাকলে তিনি এভাবে মারা যেতেন না।
হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বেনারকে বলেন, “বেসরকারি হাসপাতালগুলো ফাঁকি দিচ্ছে। চিকিৎসা দিচ্ছে না। সেকারণে আমরা আদেশ জারি করেছি, যেসকল হাসপাতাল রোগীদের চিকিৎসা দেবে না তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।”
উল্লেখ্য, গত ১১ মে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা জারি করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।